বাংলাদেশ থেকে বোমানা প্রিজন: একজন আশ্রয়প্রার্থীর সংগ্রাম কাহিনী

পাপুয়া নিউ গিনির বোমানা প্রিজনে আছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থী হেলাল “স্পাইসি” উদ্দিন। তার নামের সঙ্গে কেন “স্পাইসি” যুক্ত করা হলো? তিনি কেন মেনাস আইল্যান্ডে ফিরে যেতে চান?

Helal "Spicy" Uddin

Helal "Spicy" Uddin is now back in Papua New Guinea's Bomana prison. Source: Supplied

সাত বছর কঠোর সংগ্রামের পর এপ্রিলে ১০ দিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিলেন হেলাল “স্পাইসি” উদ্দিন।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট একটি গ্রাম থেকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস আইল্যান্ডে পাড়ি জমানো হেলাল উদ্দিনের বয়স ৩০ বছর। ২০১৩ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস আইল্যান্ড টেরিটোরিতে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আসেন। অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ এর পর তাকে পাপুয়া নিউ গিনির কুখ্যাত মেনাস আইল্যান্ড ডিটেনশন সেন্টারে বদলি করেন। আর, ২০২০ সালে তাকে পাপুয়া নিউ গিনির মূল ভূখণ্ডের বোমানা প্রিজনে আনা হয়।

ইতোমধ্যে জন্ম, মৃত্যু, বহিষ্কার ও বিয়ের মতো ঘটনা ঘটে গেছে।

এ বছরের এপ্রিলে কর্তৃপক্ষকে পাপুয়া নিউ গিনির ন্যাশনাল কোর্ট আদেশ দেয় হেলাল উদ্দিনকে জরুরি ভিত্তিতে মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং দেশটিতে তাকে তিন বছরের জন্য রেসিডেন্সি প্রদানের জন্য।

মুক্তির স্বাদ বড় মধুর, কিন্তু, তা বেশি দিন রইল না। প্রায় ১০ দিন পর হেলাল উদ্দিনকে আবারও কারাগারে পাঠানো হয়।

বোমানা প্রিজনে এসবিএস নিউজকে তিনি বলেন,

“আমার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র বানানো উচিত।”

স্পাইসির কাহিনী

হেলাল উদ্দিন বলেন, নিজের গ্রামের বাড়িতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ ছাড়েন।

তিনি বলেন, তিনি মনে করেছিলেন যে, তাকে জেলে দেওয়া হতে পারে এবং বিরোধী দলকে সহায়তার কারণে তাকে নির্যাতনও করা হতে পারে।

হেলাল উদ্দিনকে ‘স্পাইসি’ নাম দেওয়া হয়। কারণ একসময় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তিনি বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছেন।

মেনাস আইল্যান্ড ডিটেনশন সেন্টারে তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য বন্দিদের জন্য তিনি রান্না করতেন।
Mr Uddin, a former chef, cooked for detainees on Papua New Guinea's recent Independence Day celebrations.
Mr Uddin, a former chef, cooked for detainees on Papua New Guinea's recent Independence Day celebrations. Source: Supplied
মেনাস আইল্যান্ড ডিটেনশন সেন্টারে তিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তখন মানবাধিকার ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া সরকার এই সেন্টারটি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।

পাপুয়া নিউ গিনি ন্যাশনাল কোর্ট দেখতে পায় যে, হেলাল উদ্দিনকে ২ বছর ৬ মাস ধরে মেনাস আইল্যান্ডে কারাগার-সদৃশ পরিবেশে “বে-আইনীভাবে আটক” করে রাখা হয়েছে।

ভালবাসার খোঁজে

মুক্তি পাওয়ার পর সেই দ্বীপটিতে হেলাল উদ্দিন তার স্ত্রী অ্যালিস মাইকেলের দেখা পান। ২০১৭ সালের মার্চে তারা বিয়ে করেন।

তিনি বলেন,

“আমি মুক্তি পাই এবং আমার স্ত্রীকে একটি চায়নিজ সুপারমার্কেটে দেখি। তখন আমি তার প্রেমে পড়ি এবং তাকে বিয়ে করি।”

বিয়ের পর মাত্র তিন সপ্তাহেরও কম সময়ে অ্যালিস একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ আলী।

২০১৭ সালে সবকিছু ঠিকভাবে চলে। মেনাস আইল্যান্ডে হেলাল উদ্দিন তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করেন। লরেঙ্গাও শহরে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি ছোট ক্যান্টিন চালাতেন। কিন্তু, তার রিফিউজি স্ট্যাটাস প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে হেলাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে কর্তৃপক্ষ।
Mr Uddin's wife Alice holds the couple's young son.
Helal's wife Alice holds the couple's young son, Mohammad. Source: Supplied
পাপুয়া নিউ গিনির অভিবাসন মন্ত্রী হেলাল উদ্দিনকে লিখেন,

“যে ছাড়ের মাধ্যমে আপনি এই দেশে প্রবেশের কোনো অনুমতি ছাড়াই থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন, সেটি শেষ হয়ে গেছে।”

“অতএব, আপনি এখন বে-আইনীভাবে পাপুয়া নিউ গিনিতে আছেন। এই দেশে থেকে আপনাকে বহিষ্কারের আদেশে এবং চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ডিটেনশনের আদেশে আমি স্বাক্ষর করেছি।”

“আপনি স্বেচ্ছায় চলে যেতে ব্যর্থ হলে, আপনাকে বহিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এরপর হেলাল উদ্দিনকে তার স্ত্রী-পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

তিনি বলেন,

“তারা আমাকে বহিষ্কার করে। কিন্তু, ভালবাসা আবার আমাকে ফিরিয়ে আনে।”

অত্যাশ্চর্য প্রত্যাবর্তন

ডিটেনশন সেন্টারের জঘন্য অভিজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ শরণার্থীরা যখন হুড়াহুড়ি করে মেনাস আইল্যান্ড ছেড়ে যাচ্ছিলেন, হেলাল উদ্দিন তখন তার পরিবারের কাছে ফিরে আসার জন্য মরিয়া ছিলেন।

তিনি বলেন,

“প্রতিদিন আমি আমার ছেলে ও স্ত্রীর জন্য কাঁদতাম।”

“আমি ভাবতাম, আমার ছেলে কী খাচ্ছে, খেলছে কিনা এবং কীভাবে থাকছে। এসব নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করতাম।”

পাপুয়া নিউ গিনিতে ফিরে আসার জন্য তিনি প্রথমে আইনী প্রচেষ্টা চালান। এর জন্য তিনি ডিপেন্ডেন্সি ভিসারও আবেদন করেন।
Mr Uddin says that his wife and son are surviving in a "harsh situation" while he is stuck in prison.
Mr Uddin says that his wife and son are surviving in a "harsh situation" while he is stuck in prison. Source: Supplied
আদালতের নথিপত্রে বলা হয়েছে যে, এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি একজন মানব-পাচারকারীকে অর্থ প্রদান করেন, তাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে পাপুয়া নিউ গিনিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

থাইল্যান্ড থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত তিনি বোটে করে যান। এর পর তিনি ২০১৮ সালের নভেম্বরে পাপুয়া নিউ গিনিতে কোনো পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করেন।

হেলাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চল নৌকাযোগে অতিক্রম করার পথে ছয় সপ্তাহের এই ভ্রমণে তার তিন জন ঘনিষ্ট বন্ধু গুলিবিদ্ধ হন ও নিহত হন।

তিনি বলেন,

“কিন্তু, আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই। আমি জানি না কেন।”
Google Maps image showing Bomana Prison location
Source: Google Maps
মৃত্যুর ঘটনা দেখে এবং নিজে বেঁচে যাওয়ায় অত্যন্ত আলোড়িত হন হেলাল উদ্দিন। এরপর তিনি ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।

হেলাল উদ্দিন এরপর পূর্ব দিকে মেনাস আইল্যান্ডে যান এবং তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে একত্রিত হন। তার জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসে।
তিনি বলেন,

“এরপর আমি আমার ছেলে ও আমার পরিবারের জন্য কাজ করি।”

কিন্তু এর কয়েক মাস পর আবারও গ্রেপ্তার হন হেলাল উদ্দিন।
Mr Uddin says he and other detainees are concerned about the possibility of coronavirus spreading inside Bomana.
Mr Uddin says he and other detainees are concerned about the possibility of coronavirus spreading inside Bomana. Source: Supplied
এ বছরের শুরুর দিকে ন্যাশনাল কোর্টের বিচারপতি ডেভিড ক্যানিংস বলেন,

“২০১৮ সালের শেষের দিক থেকে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে কয়েক মাস তার (হেলাল উদ্দিন) ও তার স্ত্রীর জন্য দৃশ্যত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল।”

“কিন্তু, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। কী কারণে তাকে গ্রেপ্তার করে সেটা পরিষ্কার নয়।”

“কোনো পরিষ্কার সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, কেন, কীভাবে, কোথায় কিংবা কখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

ব্যবসা নিবন্ধন করার জন্য পরিচয়পত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন হেলাল ‍উদ্দিন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশ করার কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন,

“আমি একজন ভাল মানুষ। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আমি পাপুয়া নিউ গিনিতে এসেছি। কিন্তু, আমি এটা ভালবাসার জন্য করেছি।”

কারাগারে প্রেরণ

পাপুয়া নিউ গিনির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে আবারও বহিষ্কার করলে এবার তাকে দেশটির মূল ভূখণ্ডের বোমানা প্রিজনে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন,

“আমার স্ত্রী ও ছেলে এখনও হাইল্যান্ডস-এ রয়েছে। তাদের কাজ নেই, পয়সাও নেই। তারা সংগ্রাম করছে। তাদের আমার সহায়তার প্রয়োজন। আমি কী করতে পারি?”
A bucket used inside Bomana prison for inmates to wash themselves.
A bucket used inside Bomana prison for inmates to wash themselves. Source: Supplied
আদালতের কার্যক্রমে নিজেই অংশ নেওয়া শুরু করেন হেলাল উদ্দিন। এরপর তার ডিপোর্টেশন স্থগিত করা হয়। তিনি যুক্তি দেন যে, পাপুয়া নিউ গিনির কর্তৃপক্ষ তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং দেশটিতে তাকে থাকার অনুমতি দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন,

“আমি আমার স্ত্রীকে চাই, পরিবারকে চাই এবং আমার ছেলেকে চাই। বর্তমানে তারা খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে আছে।”

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার বিষয়ক কেসটির শুনানি হয়। বিচারপতি ডেভিড ক্যানিংস এপ্রিলে এর রায় দেন। সেই সময় পর্যন্ত হেলাল উদ্দিন সব মিলিয়ে তিন বছর সাত মাস হয় পাপুয়া নিউ গিনিতে বন্দি ছিলেন কিংবা বে-আইনীভাবে ইমিগ্রেশন ডিটেনশনে বন্দি ছিলেন।
বিচারপতি ক্যানিংস দেখতে পান যে, হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা “কঠোর, নিষ্ঠুর এবং অন্যায্য”।

তিনি তার রায়ে লিখেন,

“মাইগ্রেশন অ্যাক্ট-এর অধীনে তার অবৈধভাবে প্রবেশ করা ছাড়া আর কোনো অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় নি।”

এ বছরের এপ্রিল মাসে বিচারপতি ক্যানিংস আদেশ দেন যে, হেলাল উদ্দিনকে পাপুয়া নিউ গিনিতে তিন বছরের জন্য বসবাসের সুযোগ (রেসিডেন্সি) প্রদান করতে হবে।

১০ দিনের জন্য মুক্তি

বিচারপতি ক্যানিংসের রায়ের পর হেলাল উদ্দিন স্বল্প সময়ের জন্য বোমানা প্রিজন থেকে মুক্তি পান।

প্রায় ১০ দিন পর কর্তৃপক্ষ জানায় যে, তারা আপিল করবে। তখন হেলাল উদ্দিনকে আবারও কারাগারে পাঠানো হয়।
Mr Uddin and another prisoner inside Bomana prison.
Mr Uddin and another prisoner inside Bomana prison. Source: Supplied
অস্ট্রেলিয়া থেকে হেলাল উদ্দিনের কেসটিতে সহায়তা করছেন শরণার্থী সমর্থক ইয়ান রিনটৌল। তিনি বলেন,

“আমরা ন্যাশনাল কোর্টে জয় লাভ করেছি। সে প্রায় ১০ দিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল। এরপর তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে।”

“তার কেসটি এখন পাপুয়া নিউ গিনির সুপ্রিম কোর্টে যাবে। তবে, কোনো তারিখ নির্ধারিত হয় নি।”

“আমরা যখন অপেক্ষা করছি তখন তাকে আবারও আটক করা হয়েছে।”

মন্তব্যের জন্য পাপুয়া নিউ গিনি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এসবিএস নিউজ।
হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনি এখনও আশাবাদী যে, একদিন তিনি মেনাস আইল্যান্ডে তার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবেন।

তিনি বলেন,

“আমি জানি না তাদেরকে আবার কবে দেখতে পাব।”

“আমার ছেলে আমাকে কল করেছে এবং বলেছে যে, আমার সঙ্গে আসতে চায়। আমি তাকে বাধ্য হয়েই বলেছি, ‘আমি কারাগারে আছি’। এটা আসলেই কঠিন।”

“আমার কাহিনী, আমার সাথে যা ঘটেছে, আমি মনে করি না আর কোনো শরণার্থীর সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটেছে।”

Follow SBS Bangla on .

Share
Published 19 October 2020 6:12pm
Updated 2 March 2021 2:52pm
By Steven Trask
Presented by Sikder Taher Ahmad


Share this with family and friends