নাগরিকত্ব ইস্যু বা সিটিজেন এমেন্ডমেন্ট অ্যাকট বা সি-এ-এ কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। অ-মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। যদিও এখনও পর্যন্ত এই আইনের কোনও নিয়ম তৈরি হয় নি। দেশের পাঁচ রাজ্যের ১৩টি জেলায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের নাগরিকত্বের আহ্বান জানানো হয়েছে। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ এবং নাগরিকত্ব নিয়ম, ২০০৯ সালের অধীনে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করা সম্ভব হয় নি কেন্দ্রের তরফে।
কেন্দ্রের জারি করা বিজ্ঞপ্তির তালিকায় রয়েছে গুজরাত, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পঞ্জাব। নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে পারবেন প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অ-মুসলিম শরণার্থীরা। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, গুজরাটের মোরবি, রাজকোট, পাটান এবং ভদোদরা, ছত্তিশগড়ের দুর্গ এবং বালোদবাজার, রাজস্থানের জালোর, উদয়পুর, পালি, বার্মার এবং সিরোহি, হরিয়ানার ফরিদাবাদ,পঞ্জাবের জলন্ধরে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানরা নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে পারবেন। আবেদনগুলি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির প্রশাসনিক আধিকারিকদের। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ৫ টি রাজ্যের মধ্যে তিনটিতে কংগ্রেসের শাসন। এরমধ্যে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থানে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ‘লাগু’ (প্রয়োগ) না করার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাস করা হয়।
২০১৯ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ হয়। এই আইনের আওতায় ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে যে সব হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি ও খ্রিস্টান অর্থাৎ অ-মুসলিম উদ্বাস্তুরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলেও তা শীঘ্রই রূপায়ণ করা হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
উল্লেখ্য, গতবছর ১০ জানুয়ারি থেকে ভারতে কার্যকর হয়েছিল সি-এ-এ অথবা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই আইনের কোনও নিয়ম তৈরি হয় নি। ২০১৯ সালের শেষ থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল সি-এ-এ বিরোধী আন্দোলন। দিল্লিতে সহিংসতার ঘটনায় ৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। চাপের মুখে আইন পাশ করেও তাই বলবৎ করতে পারে নি কেন্দ্রীয় সরকারর। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাজেট অধিবেশনের সময় এই আইন লাগু করার সময়সীমা বৃদ্ধি করার অনুমোদন মেলে সংসদে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য জানিয়েছিলেন নাগরিকত্ব আইন করোনা টিকা দেওয়ার পর বলবৎ করা হবে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে এই নাগরিকত্ব আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে। মতুয়া ও রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চলে আইন প্রয়োগ করে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকটি আসনে জয়ী হয় বি-জে-পি । যদিও প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় বিজেপির উপর ক্ষুব্ধ হন দলীয় কর্মী-সমর্থকরাই। প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরও। বিধানসভা নির্বাচনেও এর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এই আইন নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হন।
চলতি বছরে এই আইন কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়সীমা আরও তিন মাস বাড়িয়ে দেয় সংসদীয় কমিটি। তাদের নয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৯ এপ্রিল থেকে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে কার্যকর করতে হবে এই নাগরিকত্ব আইন। ফলে অ-মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া কার্যত থেমে গিয়েছে বলেই মত অনেকের। উল্লেখ্য, নাগরিকপঞ্জি আর নাগরিকত্ব ইস্যু বা সিটিজেন এমেন্ডমেন্ট অ্যাকট বা সি-এ-এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই সরব বুদ্ধিজীবী মহল। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বেঙ্গালুরু পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। বলিউডে যেমন অনুরাগ কাশ্যপ, স্বরা ভাস্কররা আওয়াজ তুলেছেন, তেমনই বাংলা থেকে অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, সোহাগ সেন, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ঋদ্ধি সেন পথে নেমে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে দেশজুড়ে। পালটা বিজেপি-র বক্তব্য, মুসলিম দেশগুলিতে অত্যাচারিত হিন্দু, শিখ ও অন্য সংখ্যালঘুদের বাঁচাতেই এই আইন আনা হয়েছে। এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, কেড়ে নেওয়ার নয়। সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক বাঁচাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বিষয়টির বিরোধিতা করছে।