ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে গত ১৭ জুলাই “ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি” শীর্ষক একটি সম্মেলনে যোগ দেন বিশ্বের ২৭টি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ থেকে সেখানে প্রিয়া সাহা ছাড়াও মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ দু’জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ছিলেন। সেখানে বাংলাদেশী নাগরিক ও ‘শাড়ি’ নামক একটি বেসরকারি সেবামূলক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “প্লিজ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখনও সেখানে ১৮ মিলিয়ন সংখ্যালঘু মানুষ আছে। আমার অনুরোধ, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার হয় নি।”
তাদের কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। এ সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রিয়া সাহাকে প্রশ্ন করেন, কারা তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, জমি কেড়ে নিয়েছে? উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, তারা মুসলিম মৌলবাদী, তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে।
প্রিয়া সাহার এই অভিযোগের পর শোরগোল পড়ে যায় বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মাঝে।
প্রিয়া সাহা কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন?
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আমন্ত্রণে খুব অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমেরিকায় যান। তিনি বলেন, ঐ অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ করেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউজে যাওয়ার কথা বলা হয়।
তিনি বলেন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান নি এবং সংগঠনের নেতারাও তার সফরের কথা জানেন না।
বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ঐ সম্মেলনে তাদের প্রতিনিধি হয়ে প্রিয়া সাহা জান নি। সেখানে তিনি যা বলেছেন, তাও সাংগঠনিক বক্তব্য নয়।
সংগঠন থেকে বহিষ্কার
বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ঢাকার এক নিউজপোর্টালকে জানান, সংগঠনটির অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহাকে সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের জন্য সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে সকল সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন,
“এ ধরনের খবর দেওয়ার পেছনে তার নিশ্চয় একটি কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। দেশে আসলে নিশ্চয় আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করবো।”
ঐ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন,
“প্রিয়া সাহা যে অভিযোগ করেছেন, তা একেবারেই মিথ্যা। বিশেষ মতলবে এমন উদ্ভট কথা বলেছেন তিনি।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই প্রিয়া সাহা এই ধরনের বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ করেছেন।”
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রিয়া সাহার শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ২২ জুলাই, সোমবার সমাবেশ থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এতে প্রিয়া সাহার নিন্দাজ্ঞাপনের পাশাপাশি তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের আবেদনও জানানো হয়। হোয়াইট হাউজের সামনে এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে মেট্রো ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ
প্রিয়া সাহা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন দাবি করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “এই বক্তব্যটি (প্রিয়া সাহার অভিযোগ) সম্পূর্ণ অসত্য ও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি নিন্দনীয় অপরাধই শুধু নয়, এ ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত মতলববাজ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সহায়তা করবে।”
এরপর, ২১ জুলাই রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক বিষয়ক একটি সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাতে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রিয়া সাহা কেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন সেই ব্যাখ্যা না শুনে তড়িঘড়ি কোনো আইনি ব্যবস্থায় না যেতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার কথা জানানোর আগেই রবিবার সকালে ঢাকার হাকিম আদালতে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দুটি মামলার আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে আদালত এগুলো নাকচ করে দেয়।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ‘দুরভিসন্ধি’ দেখছেন প্রধানমন্ত্রী-পুত্র জয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় গত রবিবার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেন,
“এই ধরনের কাজের পিছে একটাই কারণ চিন্তা করা যায়: মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।”
চক্রান্তের গন্ধ খুঁজছেন সংখ্যালঘুরা
প্রিয়া সাহার এই অভিযোগের পেছনে নানা রকম চক্রান্তের গন্ধও খোঁজা হচ্ছে। ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। গত রবিবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান তিনি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তও চেয়েছেন তিনি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, একটি সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি আবারও এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার হীন চেষ্টায় রত।”
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন প্রিয়া সাহা
নিজের অবস্থানে অনড় থাকার কথা বলে তার বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রিয়া সাহা।
আমেরিকাতে একজন সাংবাদিককে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটি ভিডিও গত রবিবার তার বেসরকারি সংস্থা শাড়ির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। ৩৫ মিনিটের সাক্ষাতকারটিতে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে সেজন্যই তিনি হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহযোগিতা চেয়েছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা তার উদ্দেশ্য ছিল না।
৩৭ মিলিয়ন (তিন কোটি ৭০ লাখ) সংখ্যালঘু নিখোঁজ হওয়ার এই পরিসংখ্যান তিনি কোথায় পেলেন- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি পরিসংখ্যান থেকে তিনি এই তথ্য দিয়েছেন।
নিজ বক্তব্যের সমর্থনে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের উল্লেখ করেন তিনি। ড. বারাকাতের একটি গবেষণা সম্পর্কে তিনি দাবি করেন, “ঐ গবেষণা কাজের সাথে আমিও জড়িত ছিলাম। সুতরাং, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত।”
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত এ বিষয়টির প্রতিবাদ করে বলেছেন, প্রিয়া সাহা আমার নাম জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।
জনমনে প্রশ্ন
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিয়ে ভিন্ন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে অসত্য অভিযোগ উত্থাপন করা কতোটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে তোলপাড়।
এদিকে, কেউ কেউ বিক্ষুব্ধ হয়ে এ বিষয়টিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করতে চাচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, আর কী বললে রাষ্ট্রদ্রোহ হবে, আর কী করলে রাষ্ট্রদ্রোহ হবে?
এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে।
পরিসংখ্যানের ভুল নিয়ে যারা শঙ্কিত নয়, তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছে অভিযোগের অন্তর্নিহিত সারসত্তা নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে কি সংখ্যালঘুরা বিতাড়িত হচ্ছে না? তারা কি দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে না?
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এএন্ডএম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাজ ও রাজনীতির অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন বলেন, “প্রিয়া সাহা যে সংখ্যা বলেছেন তা হয়তো অতিরঞ্জিত হতে পারে, কিন্তু এটা তো সত্যি যে বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।”
বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন লিখেছেন,
“ট্রাম্পকে প্রিয়া সাহা যা বলেছেন, কমই বলেছেন। খুব মাপা সময়। ভয়াবহতা বর্ণনা করার সময় তাই পাননি। লাখকে মিলিয়ন বলেছেন নাকি মিসিংকে ডিস্যেপিয়ার্ড বলেছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বাংলাদেশে চলছে, নির্যাতন চলছেই। সে কারণে নিরাপত্তার অভাবে হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। এটা মানুষ জানুক। হাসিনা এসেও যে সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা দেননি, এটাও জানুক মানুষ।
মানুষ যে দেশ ছাড়ছে, তার প্রমাণ দেশেই। প্রিয়া সাহা যদি নির্ভুল পরিসংখান দিতেন --১৯৪৭ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৯.৭ শতাংশ। ২০১১ সালের তা নেমে এসেছে ৯.৭ শতাংশে। তাহলে কি খুব চমৎকার শোনাতো? মোটেও না।”
Follow SBS Bangla on .