বরেণ্য চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের চোদ্দটি ছবি-সহ দু'শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলি হল অপুর সংসার, চারুলতা, অভিযান, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, গণশত্রু, গণদেবতা, ঝিন্দের বন্দী, তিন ভুবনের পারে, ক্ষুধিত পাষাণ, কোনি ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একাধারে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র ও মঞ্চাভিনেতা, পাশাপাশি অসামান্য বাচিক শিল্পী, কবি, লেখক, নাট্যকার এবং নাট্যনির্দেশক।
১৯৩৫ সালের উনিশে জানুয়ারি মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট লাগোয়া মির্জাপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ছেলেবেলা কাটানোর সময় তাঁর অভিনয় জীবনে হাতেখড়ি। আর এইখান থেকেই অভিনয়ে প্রতি তাঁর উৎসাহের শুরু। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে হাওড়ায় সপরিবারে চলে আসেন তিনি। কলকাতার সিটি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তী সময়ে স্নাতকোত্তরের পর বিখ্যাত অভিনেতা-পরিচালক অহীন্দ্র চৌধুরির কাছে অভিনয় শেখেন তিনি। পরে শিশির ভাদুড়ির লেখা নাটকে অভিনয় করে সবার নজর কাড়েন তিনি। এর পরে শিশির ভাদুড়ির তত্ত্বাবধানেই অভিনয় শিখতে শুরু করেন তিনি। এই সময়ে সত্যজিত্ রায়ের ছবি অপুর সংসারে কাজের সুযোগ পান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নজরকাড়া অভিনয় করায় অপু ট্রিলজি, ফেলুদার সবকটি ছবিতেই অভিনয়ে জন্য তাঁকে বেছে নেন সত্যজিত্ রায়। পরবর্তী সময়ে অভিযান, চারুলতা, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনিসঙ্কেত-সহ একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি।
কাজ করেছেন মৃণাল সেনের আকাশ কুসুম ছবিতেও। সত্যজিত্ রায়-মৃণাল সেন ছাড়াও অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কাজ করেছেন তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার সহ একাধিক পরিচালকের সঙ্গে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে একাধিক নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি।
বাবা ও ছেলের সম্পর্ক যেরকম হওয়া উচিত, সেরকমটাই ছিল সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে। এই মন্তব্য আর কারওর না, স্বয়ং সৌমিত্রের। সত্যজিতের ১৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। দু’টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিতে। প্রশ্ন উঠেছে একাধিকবার। সেসময়ে উত্তম কুমারের মতো নক্ষত্র বাংলা চলচিত্রের জগতে জ্বলজ্বল করছিলেন। রূপ, অভিনয়, ব্যক্তিত্ব। সব মিলিয়ে। অথচ কেবলমাত্র দু’টি ছবিতে মানিকদার সঙ্গে কাজ করেছেন উত্তম। কেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই বেছে নিলেন সত্যজিৎ? জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি তেমন প্রশংসা না পেলেও নায়ক ছবিটির প্রতিটি সংলাপ এখনও দেশবিদেশের মানুষের ঠোঁটে। কিন্তু সৌমিত্র ছিলেন সত্যজিতের বড্ড আপন। নিজস্ব। সবথেকে বড় কারণ, অভিনেতা যেই হোন না কেন, তিনি যেন চরিত্রকে ছাপিয়ে না যান। সত্যজিৎ রায়ের কাছে তাই সৌমিত্র ছিলেন সেই অভিনেতা, যিনি কেবল একজন রক্তমাংসের মানুষ। কফি হাউজে যাচ্ছিলেন সৌমিত্র। সেখানেই তাঁকে পাকড়াও করে সত্যজিতের বাড়িতে নিয়ে যান সত্যজিতের সহকারী পরিচালক। সৌমিত্রকে দেখে প্রথম কথাটি ছিল, এবাবা, তুমি তো কলেজের অপুর তুলনায় বয়সে অনেকটাই বড়। তারপর থেকে যতবারই তাঁদের দেখা হত, কথা বলতেন সৌমিত্র। চুপ করে শুনতেন সত্যজিৎ। এভাবেই তিনি পরখ করেছিলেন সৌমিত্রকে। সৌমিত্রের ভাষাকে, চালচলনকে।একরাশ বিষন্নতা রেখে চলে গেলেন বাঙালির আদি অকৃত্রিম ফেলুদা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। করোনাকে হার মানালেও শেষরক্ষা হল না। জীবনের ৮৫টি বসন্ত পেরিয়ে হার মানতে বাধ্য হলেন বাঙালির আদি অকৃত্রিম, ফেলুদা। প্রবাদপ্রতীম অভিনেতার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা বিনোদন জগৎ। ৪০ দিনেরও বেশি সময় ধরে বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ৬ অক্টোবর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। প্লাজমা থেরাপির পর তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল। সেইসঙ্গে চিকিৎসাতেও সাড়া দিতে থাকেন তিনি। কিন্তু আচমকাই ফের তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। চিকিৎসকরা জানান, সৌমিত্রের শরীরে সমস্যার প্রধান কারণ কোভিড এনসেফ্যালোপ্যাথি।
THE WORLD OF APU [INDIA 1959] SOUMITRA CHATTERJEE AND SHARMILA TAGORE Date: 1959 Source: AAP Image/Mary Evans Picture Library
তাঁর চেতনার মাত্রা ক্রমশ কমতে থাকে। বুধবার বর্ষীয়ান অভিনেতার ট্র্যাকিওস্টমি করা হয়েছিল। সফলভাবেই তা সম্পন্ন হয়েছিল। বৃহস্পতিবারই আবার তাঁর প্রথম পর্যায়ের প্লাজমাফেরেসিস সম্পন্ন হয়। আশা করা হয়েছিল প্লাজমাফেরেসিসের পর অভিনেতার আচ্ছন্নভাব ও অসংলগ্নতা অনেকটাই কেটে যাবে। কিন্তু শুক্রবার তার কিছুই হয় নি। উলটে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। ডা. কর জানান, এর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেতনাস্তর ৯ থেকে ১০-এর মধ্যে ছিল। তা পাঁচ পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। এই স্তর তিনে পৌঁছে গেলে ব্রেন ডেথ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। শনিবার ডা. কর জানান, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারকে পুরো বিষয়টি জানানো হয়েছে। রাত থেকে তাঁর অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। রবিবার সকালে তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে। কোনও ওষুধেই আর সাড়া দিচ্ছিলেন না তিনি। কমছিল রক্তচাপ এবং রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা।পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১২ সালে সারা জীবনের অবদানের জন্য চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০১৫ সালে টেলি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (হল অফ ফেম) ও ২০১৭ সালে 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি তাঁর অসামান্য অভিনয়ের জন্য পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি টেগোর রত্ন অ্যাওয়ার্ড সহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। ফ্রান্স সরকার শ্রীচট্টোপাধ্যায়কে ২০১৮ সালে তাঁদের সর্বোচ্চ সম্মান, 'লিজিয়ন দ্য অনার'- এ ভূষিত করে।
THE WORLD OF APU [INDIA 1959] SOUMITRA CHATTERJEE AND SHARMILA TAGORE Date: 1959 Source: AAP Image/Mary Evans Picture Library
কলেজে পড়াশোনা করতে করতেই বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অহিন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে মঞ্চের তালিম নিতে শুরু করেন। কলেজের শেষ সাল। শিশির ভাদুরীর নাটক দেখতে যান তিনি। ব্যস, সেই তিনি বুঝে গেলেন, মঞ্চ, অভিনয়, আলো, দর্শক, এই তো চাই তাঁর! ভাদুরীর মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে গুরুর পদে বসালেন সৌমিত্র। অল ইন্ডিয়া রেডিওয়ে চাকরির সুযোগ পান। কিন্তু অভিনয় নিয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেন নি তিনি। হাতে খড়ি শুরু হয়েছিল শিশির ভাদুরী ও অহিন্দ্র চ্যাটার্জির সঙ্গে। অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটকে। তাপসী,,নামজীবন, রাজকুমার, ফেরা, নীলকন্ঠ, ঘটক বিদায়, দর্পণে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর, টিকটিকি, প্রাণতপস্যা, ইত্যাদি।
কারও কাছে প্রিয় পুলুদা, কারও কাছে সৌমিত্রবাবু, কারও কাছে আবার শুধুই সৌমিত্র। কেউ ছিলেন অপুর অপর্ণা, কেউ অমূল্যর মৃণ্ময়ী, কেউ আবার অমলের চারুলতা। পর্দায় এভাবেই বারবার সৌমিত্র-সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, তনুজা থেকে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। প্রত্যেক নারীর সঙ্গে পর্দায় ভিন্ন রসায়ন ফুটিয়ে তুলেছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র।
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেতার জীবনাবসানের খবর শোনামাত্রই বেলভিউ হাসপাতালে যান তিনি। গান স্যালুটের মাধ্যমে পূর্ণ মর্যাদায় সৌমিত্রের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সর্বতভাবে সৌমিত্রর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অভিনেতার কন্যা।সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সারা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের মহান প্রতিভাবান বরণীয় স্মরণীয় মানুষকে হারাল। যার সিনেমা, নাটক, কবিতা এবং গণ অন্দোলনেও, মানবিক আন্দোলনেই ছুটে গিয়েছিলেন। শেষ কথা হয়েছিল যখন তিনি কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। মেদিনীপুরে ছিলাম। কোভিড কিন্তু নেগেটিভ হয়ে গিয়েছিল। পারিপার্শ্বিক আরও অনেক কিছু ছিল। প্রত্যেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। আমরা তাঁকে ধরে রাখতে পারিনি। মৃত্যু নির্মম হলেও বাস্তব। আজকের দিনে আমরা হারিয়েছি আমাদের এক চির ইতিহাসকে। যে জায়গায় সৌমিত্রদা পৌঁছেছিলেন সেখানে যেতে অনেক সংগ্রাম, অধ্যাবসায় লাগে। বাড়ির পর টেকনিশিয়ান স্টুডিও, রবীন্দ্রসদন হয়ে দেহ পদযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। গান স্যালুটের পরই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য হবে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সৌমিত্র কন্যা পৌলমী জানিয়েছেন, বেলভিউ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে দেহ। সাড়ে তিনটে নাগাদ রবীন্দ্রসদনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে দেহ শায়িত থাকবে ঘণ্টাদুয়েক। জানানো যাবে শেষ শ্রদ্ধা। এরপর পদযাত্রা করে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে দেহ। সেখানেই হবে শেষকৃত্য। চিকিৎসক অরিন্দম করকে ধন্যবাদ জানান তিনি। বলেন, তাঁর মতো চিকিৎসক আরও প্রয়োজন। হয়তো উনি হেরে গেলেন কিন্তু চিরকাল আমাদের মধ্যে থেকে যাবেন। সকলকে বলছি দুঃখ পাবেন না। কষ্ট পাবেন না।
In this May 3, 2012 file photo, Bengali language film actor Soumitra Chatterjee, center, gestures after receiving the Dadasahab Phalke Award for the year 2011. Source: AAP Image/AP Photo/ Manish Swarup