এর আগে,আয়লার ক্ষেত্রে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১২ কিলোমিটার।অথচ পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন উপকূলে এবার সর্বোচ্চ ১৮০ কিলোমিটার গতিতে ঝড় বয়েছে।তবে, বেশ কয়েকঘণ্টা ধরে টানা ঝড় চলছে ১৫০-১৭০ কিলোমিটার গতিতে,শুধু তাই নয়, কলকাতাতেও ঝড়ের সর্বোচ্চ গতি উঠেছে ১৩০ কিমি।
এরই মধ্যে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।ইতিমধ্যে আম্ফানের দাপটে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।হাওড়াতে মৃত্যু হয়েছে এক কিশোরীর।টিনের চাল উড়ে গলা কেটে তাঁর মৃত্যু হয়।বসিরহাট মহকুমায় ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে এখনও পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
বসিরহাট মহকুমার মিনাখাঁর দক্ষিণ বারগা গ্রামে নূরজাহান বেগম নামে এক মহিলার ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে।অন্য দিকে ওই মহাকুমার মাটিয়া থানার মমিনপুর গ্রামে ঘর চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে মহতা দাস নামে ২২ বছরের এক যুবকের।যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার রাতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুমে বসে জানিয়েছেন ,প্রাথমিকভাবে ১০/১২ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে।
ওই জেলাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আপাতত জানা যাচ্ছে।বুধবার রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর ও কলকাতাতে চলছে প্রবল বেগে ঝড়।ইতিমধ্যে উপকূলে প্রায় ১৫০-১৬০ কিলোমিটার বেগে তাণ্ডব চালিয়েছে আমপান।কলকাতাতে বয়েছে ১০৫ কিলোমিটার বেগে ঝড়।তবে, আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে,কলকাতায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৩০ কিমি।
উপকূলে আছড়ে পড়ার আগেই কলকাতায় তাণ্ডব শুরু করে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, সন্ধে ৭টা বেজে ২০ মিনিটে কলকাতায় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার।কলকাতা পুলিশ সূত্রে খবর,শহরের অন্তত ৩০০টি জায়গায় গাছ ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও কয়েকশো বিদ্যুৎ এবং বিল বোর্ডের পোস্ট ভেঙে পড়ার খবরও পাওয়া গিয়েছে।
ঝড়ের আগে থেকেই শহরের সব ফ্লাইওভার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।অন্য দিকে গাছ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি সরানোর কাজও শুরু হয়।পাশাপাশি শহর জুড়ে চলছে তুমুল বৃষ্টি।প্রবীণরা বলেছেন,এমন ঝড় এই দশকে কেউ দেখেননি।প্রায় ১১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে তীব্র বাতাস বয়েছে কলকাতা এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে, চলছে ভারী বৃষ্টিপাত।সাধারণ মানুষ তাদের বাড়ি থেকে এই প্রলয়ের বেশ কয়েকটি ভিডিও এবং ছবি শেয়ার করেছেন যাতে ঘূর্ণিঝড়ের মারাত্মক প্রভাব স্পষ্ট।পার্কিংয়ে রাখা গাড়িগুলি পর্যন্ত শক্তিশালী ঝড়ের দাপটে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে,এমনই দৃশ্য দেখা গিয়েছে বহু আবাসনে।
জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী ,এনডিআরএফ প্রধান এসএন প্রধান জানিয়েছেন,পশ্চিমবঙ্গে ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ ও ওড়িশায় দেড় লক্ষের বেশি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় কলকাতাকে কার্যত তছনছ করে দিয়েছে।
এদিকে,কলকাতা-সহ বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ান ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে।আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী,২১ তারিখ সকাল পর্যন্ত এই ঘূর্ণিঝড় তার সাইক্লোন স্ট্যাটাস বজায় রাখবে।মূলত বাংলাদেশ ঘেঁষা নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনায় জারি থাকবে বিপর্যয়।পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুরেও প্রবল বৃষ্টি হবে।মালদা, উত্তর দিনাজপুরে বৃষ্টি বাড়বে। ধীরেধীরে গতিবেগ কমবে।তারপর বাংলাদেশের দিকে সরে যাবে ঝড়।
শুধু তাই নয়, রাজ্যের বিপুল অংশে ১১৫-১৩০ কিমি বেগে ঝড় বইবে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন,বাংলাদেশ ঘেঁষা নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনায় এই ঘূর্ণিঝড় নিজের অস্তিত্ব জানান দেবে।সেইসঙ্গে ঝড় বইবে ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে।বাদ যাবে না উত্তরবঙ্গেও জেলাগুলোও।মালদা, উত্তর দিনাজপুরে বৃষ্টি বাড়বে।বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই বৃষ্টিপাতের পরিমান আরও বাড়বে বলে জানানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে যা খবর পাওয়া যাচ্ছে,দক্ষিণ ২৪ পরগনার কচুবেরিয়ার জেটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। কাকদ্বীপ,কৈখালি, কুলতলি, পাথরপ্রতিমায় একের পর এক বাঁধ ভেঙে পড়েছে।বানভাসী হয়েছে বহু গ্রাম।ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু হাজার-হাজার কাঁচা বাড়ি।সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গোসাবার ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে এখনও পর্যন্ত ৫০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে এনেছে প্রশাসন।
এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন,ইতিমধ্যেই দশ-বারো জনের মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছেছে।তাঁর কথায়, মৃত্যুর সংখ্যা হয়ত কমানো গিয়েছে,কিন্তু সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতি বাংলার জন্যে। ওডিশা বেঁচে গিয়েছে। দীঘার ক্ষতি যতটা ভেবেছিলাম,তা হয়নি।কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তা, ঘরবাড়ি, ব্রিজ সব ভেঙে পড়েছে। এখনও সব খবর পাইনি।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,এলাকার পর এলাকা ধ্বংস, তিন-চারদিন সময় লাগবে রিপোর্ট পেতে।
৫ লক্ষ মানুষকে সরিয়েছিলাম, এতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠল এই ঝড়! তাঁর কথায়,বিভিন্ন জেলায় মানুষদের নিরাপদে স্থানে সরানো হয়েছিল। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমরা সিরিয়াসলি যদি না নিতাম, ৫ লক্ষ মানুষকে না সরালে কত মানুষ মারা যেতেন, জানি না। রাজ্য সচিবালয়ের,নবান্নেরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।মুখ্যমন্ত্রী সচিবালয়ে তাঁর রুমে ঢুকতে পারেন নি। কাঁচ ভেঙে গেছে।
এর আগে,পর পর দু'বছর ঘূর্ণিঝড় বাংলা শেষবার দেখেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে।অর্থাৎ, তিন দশক পর এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো পশ্চিমবঙ্গ। বুলবুলের ক্ষত পুরোপুরি সারিয়ে ওঠার আগেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। অথচ, বাংলায় বুলবুল এসেছিল আয়লার ঠিক দশ বছর পরে।তার আগে ঘূর্ণিঝড়টি এসেছিল ২০০২ সালে।অনেকগুলি বছরের বিরতি দিয়ে।পর পর দু'বছর পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আসার ঘটনাও খুব কম।
রাজ্যের ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ সময়কাল ধরা হয় ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালকে।সে সময় প্রতি বছরই একটি করে ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপ্টা সইতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গকে।এর মধ্যে শেষ বার একই বছরে দু'টি।পর পর দু'বছর আবার ঘূর্ণিঝড় দেখা যায় ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে। বুলবুল-আম্ফান সেই স্মৃতিই উস্কে দিয়েছে। আর এখন পর্যন্ত যা ধারণা করা হচ্ছে, তাতে ধ্বংসালীলার আয়লাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।