রোহিঙ্গা সঙ্কটের পাঁচ বছর পূর্তি: শরণার্থীদের জন্য কী রকম সহায়তা করছে অস্ট্রেলিয়া?

Bangladesh Rohingya

In this June 2, 2020, file photo, people shop for vegetables at the Kutupalong Rohingya refugee camp in Cox's Bazar, Bangladesh. Bangladeshi police said a key refugee leader, Mohibullah, was shot to death in the Kutupalong camp by unknown gunmen late Wednesday, Sept. 29, 2021. The 50-year-old former teacher was among 700,000 Rohingya who fled into Bangladesh after a military crackdown against the ethnic group in Myanmar in 2017. Source: AAP / Shafiqur Rahman

ভয়াবহ সামরিক ক্রাকডাউনের মাঝে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যায় পাঁচ বছর আগে। এই নৃশংস আক্রমণের ফলে একটি বড় ধরনের মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। এই সঙ্কট আজও অব্যাহত রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। শরণার্থী শিবিরগুলোর অভ্যন্তরের পরিবেশ ও নিরাপত্তা-ব্যবস্থা ক্রমাগতভাবে খারাপ হচ্ছে। “ভুলে যাওয়া সঙ্কট” হিসেবে এখন যেটিকে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেটির জন্য সহায়তা প্রদান বৃদ্ধির জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।


জীবন-ব্যাপী দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে গেলেও নুরুল আমিনের ধর্ম-বিশ্বাস এখনও পোক্ত।

সিডনির নর্থ-ওয়েস্ট অঞ্চলে, লাকেম্বার একটি বাড়ির পেছনে অস্থায়ীভাবে একটি নামাজের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন মিস্টার আমিন।

জুলুম-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার পরিবার যখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যায় তখন নুরুল আমিন খুব ছোট ছিলেন।
জীবনের প্রথম ১৫ বছর পর্যন্ত তিনি শরণার্থী শিবিরে কাটিয়েছেন।

তার কোনো ভাল ভবিষ্যৎ দেখতে না পেয়ে নুরুলের মা তাকে বলেন, কোনো পথের সন্ধান করতে।

এরপর, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া হয়ে ২০১২ সালে অবশেষে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন বলে জানান নুরুল আমিন।

বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবগণ অন্যান্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে এখনও নির্জীব জীবন কাটাচ্ছেন।

চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডেসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়েরেস বা MSF-এর সাউথ ইস্ট এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক প্রজেক্টের প্রধান, পল ম্যাকফান বলেন, দশকের পর দশক ধরে এথনিক সংখ্যালঘুদের প্রতি নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।

২০১৭ সালের আগে কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে প্রায় ৩৪,০০০ শরণার্থী ছিলেন। সেই বছরের আগস্টে বার্মিজ মিলিটারি ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালায় রোহিঙ্গাদের ওপরে।
MSF-এর মতে, সেই মাসে সহিংসতায় নারী-শিশুসহ প্রায় ৭,০০০ লোক নিহত হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছে যে, অন্তত ২৮৮টি গ্রাম হয় আংশিকভাবে কিংবা পুরোপুরিভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে নর্দার্ন রাখাইন স্টেটে, যেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে বসবাস করে।

এই নৃশংস আক্রমণের ফলে গণহারে রোহিঙ্গারা সেই স্থান ত্যাগ করে। এভাবে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে চলে আসে।

এর পাঁচ বছর পরে, মিস্টার ম্যাকফান বলেন, বিভিন্ন স্থানে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, প্রাথমিকভাবে নির্মিত শিবিরগুলোতে এখন এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
এই শিবিরগুলো এই সঙ্কটটির অস্থায়ী সমাধান হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেই একই সামরিক শক্তি আবারও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, যাদের কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছে।

আর তাই, প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা, যা ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়েছে, তা ব্যাহত হচ্ছে।

শরণার্থী শিবিরগুলোর অবস্থা এখন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। আর, একই ঘটনা ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও।

এখানে এই জনগোষ্ঠীর একজন নেতা মোহাম্মদ রউফ বলেন, আমাদের সমস্যাটিকে উপেক্ষা করবেন না। আমাদের বেশিরভাগই হয় এখানে কষ্ট করছেন, নতুবা শরণার্থী শিবিরে কষ্ট করছেন।

লাকেম্বার একটি বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডের একটি শেডে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নেতা মোহাম্মদ রউফ প্রতি সপ্তাহে সভা করেন।

১৯৮০ এর দশকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসেন মোহাম্মদ রউফ। ২০১৭ সালে তিনি আরাকান রোহিঙ্গা ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। নবাগতদেরকে এটি সহায়তা করে থাকে এবং রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে।

তিনি বলেন, তিনি-সহ এখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন ক্যাম্পগুলোতে।

লেবার সরকারের প্রতি মিস্টার রউফ আহ্বান জানান রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে বেশি সংখ্যায় গ্রহণ করতে। তিনি বলেন, কর্মী-সঙ্কট পূরণে তারা ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এসবিএস নিউজকে পাঠানো একটি স্টেটমেন্টে ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স এর একজন মুখপাত্র বলেন, অস্ট্রেলিয়া সরকার “উদার এবং নমনীয় হিউম্যানিটেরিয়ান সেটেলমেন্ট প্রোগ্রামগুলোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেগুলো আন্তর্জাতিক সুরক্ষার বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করে”। তিনি আরও যোগ করেন যে, ২০০৯ সাল থেকে “৪৭০টিরও বেশি ভিসা প্রদান করা হয়েছে হিউম্যানিটেরিয়ান প্রোগ্রামের আওতায়, রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত লোকদের জন্য।”

কিন্তু, জাতিসংঘ বলছে, অস্ট্রেলিয়ার উচিত আরও বেশি অবদান রাখা। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার ফর প্রটেকশন, জিলিয়ান ট্রিগস এসবিএস নিউজকে বলেন, তাদের জন্য যে অর্থায়ন করা হয়েছে তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালু করার জন্যও অস্ট্রেলিয়ার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ডিপার্টমেন্ট অফ হোম অ্যাফেয়ার্স-এর একজন মুখপাত্র এসবিএস নিউজকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রতি নিয়মিত নজর রাখছে অস্ট্রেলিয়া।”

এদিকে, মোহাম্মদ রউফ মনে করেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়টির জন্য অবশ্যই আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আরও একটি প্রজন্মকে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না বিশ্ব।

প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share