ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদের আগে প্রতিবছর বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনা-বেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী, লকডাউন, অর্থনৈতিক মন্দা- এসব নানা কারণে এ বারের কোরবানির ঈদ কেমন হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ার পর গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে। এগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালন পালন করে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এবার গরু-ছাগল কেনা বেচা নিয়ে এক ধরনের সঙ্কট হতে পারে বলে বিক্রেতা ও ক্রেতারা আশঙ্কা করছেন।
পশু কেনা-বেচা এবং এরপর চামড়া কেনা-বেচাসহ ঈদ-উল-আযহা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সে জায়গায় একটি বড় ধাক্কা আসতে যাচ্ছে, এ রকম আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।এদিকে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা। সারাবছর কসাইখানায় গরু বিক্রির সুযোগ থাকলেও ক্ষুদ্র খামারিদের লক্ষ্য থাকে কোরবানির হাটে বেশি লাভে পশু বিক্রি করার। বিশেষ করে যারা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একটি বা হাতে গোনা কয়েকটি গরু লালন পালন করছেন, তারা এ বছর উপযুক্ত দামে গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা, সেটা নিয়ে সংশয়ে আছেন।
A livestock vendor sleeps among cattle at a market ahead of the Muslim festival Eid al-Adha or the 'Festival of Sacrifice', in Dhaka on July 24, 2020. Source: MUNIR UZ ZAMAN/AFP via Getty Images
ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় তৈরি করেছে মহামারী-সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। আর, পরিস্থিতিকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলেছে উত্তরাঞ্চলের বন্যা। গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজের প্রাদুর্ভাবও দেখা দিয়েছে কোনো কোনো স্থানে। সব মিলিয়ে দেশের সবখানেই এখন মারাত্মক দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন অনেক খামারি। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
নিরাপদে কোরবানির পশু কেনার জন্য অনেকেই এবার বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন ডিজিটাল কোরবানির হাটে। সরকারিভাবেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে এসব হাট পরিচালনার জন্য। পশু কেনার পাশাপাশি কোরবানি সংক্রান্ত অন্যান্য কেনাকাটাও করা যাবে অনলাইনে।
গাবতলী কিংবা আফতাবনগরে হাটে হাটে ঘুরে বেড়ানোর বদলে ঘরে বসে মাউসের ক্লিকেই পশু বেছে নেওয়ার কথা ভাবছেন অনেকেই। ব্যস্ততা ও ভোগান্তি এড়াতে নগরজীবনে কোরবানির পশু বেচাকেনার আয়োজনে এবার তুমুল ব্যস্ত ই-কমার্স সাইটগুলো।
ঘরে বা অফিসে বসেই গ্রাহকদের পছন্দের গরু বা ছাগল কেনাকাটার সুযোগ দিতে কোরবানির এই ভরমৌসুমে নতুন রূপে সেজেছে ওয়েবসাইটগুলো। অনলাইনে খামারির কাছ থেকে কোরবানির পশু কিনতে এবং ক্রেতার কাছে বিক্রি করতেও বাহারি সব অফার নিয়ে এরই মধ্যে হাজির তারা। পাশাপাশি গরু-খাসি বিক্রির জন্য খোলা হয়েছে নতুন ফেসবুক পেজও।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগে চালু হয়েছে কোরবানির পশু বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘’। উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সরকারের তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগ, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এই ডিজিটাল হাট বাস্তবায়ন করছে। এই হাটের বিভিন্ন সুবিধার মধ্যে রয়েছে লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে পশু দেখা, সরেজমিনে পশু দেখা, সার্বক্ষণিক মনিটরিং প্রভৃতি।
এই হাট থেকে পশু কেনার পাশাপাশি চাইলে ক্রেতারা মাংস প্রসেস করে নিজ ঠিকানায় নিতে কিংবা আত্মীয়ের বাসাবাড়িতে পাঠাতেও পারবেন। চাইলে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাংস অসহায়দের মধ্যে বণ্টনও করে দেবে আয়োজকরা।
করোনা মহামারির কারণে রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাটের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। শুরুতে ২৪টি হাট বসানোর উদ্যোগ থাকলেও এখন দুই সিটি এলাকায় মাত্র ১১টি হাট বসবে। এর মধ্যে ছয়টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং পাঁচটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায়।
অন্য হাটগুলোর বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। যেসব হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলোরও বেশিরভাগ নগরীর প্রান্তসীমায়। বাকিগুলো বসবে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা স্থানে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়ে ইজারাদারদের বেশকিছু শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো অনুসরণ না করলে ইজারা বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া যারা পশু কিনতে যাবেন, তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে হাটে প্রবেশ করতে হবে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দুই সিটি করপোরেশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিএসসিসি জানিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবার ডিএসসিসিতে পাঁচটি পশুহাট বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। ডিএনসিসি এবার যে ছয়টি স্থানে পশুহাট বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে, তার সবগুলোই ঢাকা শহরের বাইরে।
কোরবানির পশু কেনার পর তা কাটার জন্য কসাই খুঁজে পাওয়াটা ঈদের সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইনে গরু বিক্রির পাশাপাশি কয়েক ক্লিকে বুক করা যাবে কসাইও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও পাওয়া যাচ্ছে কসাই। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের পশুর মূল্যের ওপর প্রতি হাজারে ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা প্রদান করতে হবে। সেবাটি শুধু ঢাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ঢাকা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন