হঠাৎ দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় মন খারাপের মধ্যেই বুধবার রাতে জনতা আওয়াজ তুলেছে, বিচার যত পিছোবে, মিছিল তত এগোবে। প্রতিবাদের আগুন যে নিভবে না তা টের পাওয়া গিয়েছে বুধবার সন্ধ্যে থেকেই।
রাত দখলের কর্মসূচি হলেও সন্ধ্যে থেকেই কলকাতা থেকে জেলা কোথাও মানব বন্ধন, কোথাও গান-পথনাটিকা, কোথাও আবার প্রদীপ মোমবাতি জ্বালিয়ে নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে পথে নেমেছেন চিকিৎসক থেকে আইনজীবী, শিক্ষক থেকে ইঞ্জিনিয়ার-সেলিব্রিটিরাও। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিচারের দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁরাও। গোটা কলকাতা, গোটা রাজ্য।
সেই সঙ্গে সহকর্মীর ধর্ষণ এবং খুনের বিচারের দাবিতে এক অন্য কোজাগরি পালন করেছে আর জি কর। প্রায় নিষ্প্রদীপ হাসপাতালে প্রদীপ-মোমবাতির আলোয় উঠেছে বিচারের দাবি। প্রদীপের আলোয় লেখা, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। বিচারের দাবি যেমন উঠেছে, তেমনই সহকর্মীর খুনের বিচার না পাওয়া পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের শপথও নিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। সঙ্গে সাথী সিনিয়র ডাক্তার থেকে নার্স মেডিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ। আর জি করের জরুরি বিভাগের সামনে তখন জ্বলছে মোমবাতি, যে ভবনের ৪ তলায় উদ্ধার হয়েছিল তাদেরই সহকর্মীর দেহ। পোস্টারে তখন লেখা অবিচারের ২৭ দিন।
বুধবার সন্ধ্যায় জুনিয়র চিকিৎসকদের অদম্য এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে সোদপুর থেকে আর জি করে আন্দোলনে এসেছিলেন নির্যাতিতার বাবা-মা, কাকু-কাকিমাও। রীতিমত সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, এক মেয়েকে হারিয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়েকে পাশে পেয়েছেন। আর এই ছেলেমেয়েদের আন্দোলনের জেরে তাঁর মেয়ের খুনের বিচার পাবেন বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছেন নির্যাতিতার মা। হাতজোড় করে চেয়েছেন বিচার, দোষীর শাস্তি।
এর আগে জানা যায় বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে বসছে না প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। সুতরাং, আর জি কর মামলার শুনানি হচ্ছে না। বুধবার সন্ধ্যায় শীর্ষ আদালতের তরফে সেই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ৫ সেপ্টেম্বর আদালতে বসবেন না। ফলে বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের সঙ্গে তাঁর বেঞ্চ বৃহস্পতিবার বসছে না। তবে এই দুই বিচারপতি পৃথকভাবে বেঞ্চ বসাবেন এবং ১০ নম্বর কোর্টের কিছু মামলা শুনবেন। সেই বেঞ্চে কোন কোন মামলা শোনা হবে, তার তালিকা পরে প্রকাশিত হবে।
কিন্তু আর জি কর মামলার শুনানি কবে হবে তা জানানো হয় নি। তবে শুক্রবার আর জি কর সংক্রান্ত কয়েকটি মামলা সুপ্রিম কোর্টে লিস্টেড রয়েছে। তারমধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের দায়ের করা মামলা। ফলে ওই মামলাগুলির সঙ্গে আর জি কর মামলার শুনানি হবে কিনা তাও এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে, নিষ্প্রদীপ আর জি করে যখন নির্যাতিতার বাবা মা বুঝে উঠতেই পারছেন না যে তাঁর মেয়ের খুনের বিচারের জন্য এতদিন কেন অপেক্ষা করতে হবে, তখন তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা অন্ধকারে ডুবেছে কলকাতা। যেন লজ্জায় অন্ধকারে মুখ লুকাতে। বুধবার সন্ধ্যায় ঘড়ির কাটা ৯টা ছুঁতেই আলো নিভেছে ইএম বাইপাস থেকে শুরু করে গড়িয়াহাট, গড়িয়া, বেহালা, যাদবপুর, নাকতলা, শ্যামবাজার। বহরমপুর থেকে হাওড়া, শিলিগুড়ি থেকে ধর্মতলা। বৈদ্যুতিক আলোর বদলে তখন শুধুই ভরসা মোমবাতি, প্রদীপ আর মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট। সন্ধ্যাতেই জানা গিয়েছিল বৃহস্পতিবার হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টের শুনানি।
কেন এই সিদ্ধান্ত তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে তখন শুধুই চর্চা। ক্যামেরা বুমের সামনে বলেও ফেলেছেন ক্ষোভের সেই কথা। বিখ্যাত শিল্পী মমতা শঙ্কর থেকে আমজনতা। প্রায় নীরবে এসে প্রতিবাদ জানিয়ে গিয়েছেন আরেক শিল্পী এবং সদ্য প্রাক্তন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। কলকাতার ল্যান্ডমার্ক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে জাতীয় পতাকা হাতে তখন প্রতিবাদ চলছে সামনে প্রদীপের আলোয় অন্ধকার থেকে উত্তোরণের আশা। অফিস থেকে বাড়ি, ফ্ল্যাট থেকে আবাসন মিছিলে হেঁটেছে কলকাতা। আর জি করে খুন হয়ে যাওয়া এক মেয়ের জন্য। যে হতে পারত দেশের অন্যতম চেস্ট স্পেশালিস্ট।
এর মধ্যেই রাজভবনের আংশিক আলো নিভিয়ে মোমবাতি অলোয় নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে রাজ্যবাসীর সঙ্গেই সামিল রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। আর জি করের চিকিৎসক খুনের প্রতিবাদে যখন আলো নিভিয়ে রাস্তায় নেমে মানব বন্ধন, গান-পথনাটিকায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে প্রশাসনের গাফিলতি, তখন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মোমবাতি জ্বালিয়ে মানুষের সেই আওয়াজ কেই তুলে ধরে বলেছেন, এনাফ ইজ এনাফ। অনেক হয়েছে এবার আর বরদাস্ত নয়। রাজ্যসরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে মহিলাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা।
ওদিকে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কী কী পদক্ষেপ করেছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার, জানতে চেয়ে রিপোর্ট তলব করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১০ সেপ্টেম্বরের আগে ওই রিপোর্ট জমা দিতে হবে রাজ্যগুলিকে। এই মর্মে প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব অপূর্ব চন্দ্র। চিঠি গিয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং পুলিশের ডিজিদের কাছে।
কেন্দ্রের চিঠিতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়ে ২৩ আগস্ট কেন্দ্রের তরফে রাজ্যগুলিকে যে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তার অধিকাংশের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ করা হয়েছে। পদক্ষেপের কথা কেন্দ্রকে জানানোও হয়েছে। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোথায় কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার, তা রিপোর্ট আকারে কেন্দ্রকে জানাতে হবে।