চিকিৎসক জানিয়েছেন, মাল্টি অর্গান ফেলিওরের কারণে মৃত্যু হয়েছে লতা মঙ্গেশকরের। করোনা এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এই সুর সম্রাজ্ঞী। সম্প্রতি অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু, শনিবার আচমকা তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ভেন্টিলেশনে দিতে হয় তাকে। সেখানে থেকে আর ফেরানো যায় নি তাকে। ১১ জানুয়ারি থেকে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ৩০ জানুয়ারি এই কিংবদন্তি শিল্পীর কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু, বয়সজনিত সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেন না লতা মঙ্গেশকর। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা ভারত।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
সোশ্যাল মিডিয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লতা মঙ্গেকরের মৃত্যুতে দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগেও একাধিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এই কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী। কিন্তু, প্রত্যেকবার অনুরাগীদের আশ্বস্ত করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য।
১৯২৯ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর আল মারাঠি পরিবারে জন্ম লতা মঙ্গেশকরের। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আগে অবশ্য বাবার হাত ধরেই অভিনয় এবং গান শিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। ১৩-১৪ বছর বয়সে প্রথমবার সিনেমায় গান গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। মারাঠি সিনেমাতে। মুম্বই যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম হিন্দি সিনেমায় গান গেয়ে ছিলেন তিনি, মজবুর ছবিতে।
বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় ৩০ হাজার গান গেয়েছেন সুর সম্রাজ্ঞী। ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে-সহ একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর।
১৯৪৫-এ চলে যান মুম্বই; অর্থাৎ, তৎকালীন বম্বেতে। এর কিছুদিন পরেই গুলাম হায়দারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। পরে এক সাক্ষাৎকারে যাঁকে গডফাদার হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। হায়দার সাব, ছোট্ট লতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত প্রযোজক শশধর মুখার্জির কাছে। তাঁর পছন্দ হয় নি লতার কণ্ঠ। মনে হয়েছিল, মেয়েটির গলা তেমন নয়। বিরক্ত হায়দার সাব সেদিন বলেছিলেন, একদিন এই কণ্ঠের জন্যই প্রযোজকদের লাইন পড়ে যাবে। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল সে কথা। ১৯৪৮ সালের ছবি মজবুর-এ তিনি লতাকে দিয়ে গাইয়েছিলেন গান, দিল মেরা তোটা, মুঝে কহিঁ কা না ছোড়া। বাজিমাত হয়েছিল সেই গানে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি লতা মঙ্গেশকরকে। হায়দার সাব শুধু রত্ন চিনেছিলেন তা নয়, চিনেছিলেন কোহিনূর।
পরবর্তী কয়েক দশক জুড়ে ভারতীয় সঙ্গীতকে ক্রমশ নিজের প্রতিভায় বশ করে ফেলেছেন লতা। শুধু প্রযোজকদের চাহিদাতেই তার মূল্যায়ণ হয় না। বহু সঙ্গীত-প্রতিভার জন্ম দিয়েছে এই দেশ, আর তাঁরা সবিস্ময়ে লক্ষ করেছেন লতা মঙ্গেশকরকে। এমন কণ্ঠ, এমন রেওয়াজ, এমন দক্ষতা, উৎকর্ষ এবং নিখুঁত উপস্থাপনা, একজন সঙ্গীতশিল্পীর মধ্যে বহুগুণের এহেন অপূর্ব নিখুঁত সমাবেশ হয় কী করে! উত্তর মেলে নি। অথবা, উত্তর একটাই, এই প্রতিভা ঐশ্বরিক।
সে সময় ভারতীয় সঙ্গীত ক্রমশ তাঁর কণ্ঠ ছুঁয়ে অন্যতর ও ভিন্নতর উচ্চতা লাভ করতে থাকে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী থেকে শুরু করে এ আর রহমান – লতা মঙ্গেশকরের সুরের সফর যেন ভারতীয় সঙ্গীতের এক চলমান ইতিহাস। ভারতরত্ন তিনি, পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে সম্মানও। আসলে, যে-কোনও সম্মানই যেন সম্মানিত হয়েছে তাঁকে স্পর্শ করে। প্রতিভা, বিস্ময় প্রতিভা ইত্যাদি শব্দবন্ধ পেরিয়ে একটি অন্য স্থানাঙ্কে অবস্থান কিন্নরকণ্ঠীর, যেখানে তাঁর বিশেষণ তিনি নিজেই। লতা মঙ্গেশকরের নামের আগে কোনও শব্দ বসিয়ে তাঁকে মহিমান্বিত করা বাহুল্য। তিনি নিজেই ভাস্বর, উজ্জ্বল, নির্বিকল্প এবং নক্ষত্র।
এই কোকিলকণ্ঠীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ভাষা হারিয়েছি। অত্যন্ত দয়ালু ও আদরের লতাদিদি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়া এমন এক শূন্যতা তৈরি করল, যা কখনওই পূরণ হওয়ার নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির একজন কিংবদন্তি হিসেবেই লতা মঙ্গেশকরকে মনে রাখবে আগামী প্রজন্ম, যাঁর সুরেলা কণ্ঠ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা গান ও পূর্বের শিল্পীদের এত ভালবাসা দেওয়ায় প্রয়াত এই কোকিলকণ্ঠীকে তিনি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ লিখেছেন, স্বর্গীয় সুর। অতুলনীয় মানুষ। একজন ভারতরত্ন। লতাজির কৃতিত্ব অতুলনীয়। তিনি আরও লিখেছেন, লতাজির মৃত্যু হৃদয় বিদারক। তাঁর গানে দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ফুটে উঠত।
১৯৪৯ সালে জিয়া বেকারার হ্যায়' উতলা করে দিয়েছিল শ্রোতাদের মন ৷ ১৯৫৫ সালে, মন দোলে মেরা তন দোলে, দুলিয়ে দিয়েছিল সারা দেশের মনকেই। ১৯৫৭ সালের, আজা রে পরদেশী ডাক পৌঁছে গিয়েছিল সঙ্গীতরসিকদের মর্মস্থলে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। মুম্বই (তৎকালীন বম্বে) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মাথায় তুলে নিয়েছিল লতাকে। ক্রমে সঙ্গীত পরিচালকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তাঁরই দখলে। তিরিশ হাজারেরও বেশি গান গাইবার বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী লতা। শোনা যায়, ১৯৫৯ সালেই সপ্তাহে গড়ে তিরিশটির মতো গান রেকর্ড করতে হত লতা মঙ্গেশকরকে। ১৯৭১ সালের মধ্যেই লতা মঙ্গেশকর রেকর্ড করে ফেলেছিলেন প্রায় পঁচিশ হাজার গান।
সুর ও সঙ্গীতের সুবিস্তৃত ভুবনে লতা মঙ্গেশকর এক আশ্চর্য বিস্ময়! তিনি 'জীবন্ত কিংবদন্তি' ছিলেন বললেও বোধ হয় লতার সবটা প্রতিফলিত হয় না। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব চেয়ে প্রতিযোগিতাময় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে রয়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এক সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী হয়ে!
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: