গত কয়েক বছর ধরে প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন উস্তাদ রশিদ খান। চিকিৎসায় সাড়াও দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে সম্প্রতি তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। সেখান থেকেই অবস্থার অবনতি শুরু। মঙ্গলবার বিকেলে প্রয়াত হন তিনি। রেখে গেলেন স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক পুত্রকে।
১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রাশিদের। তিনি রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিল্পী; যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব। রশিদ তালিম নিয়েছেন এই ঘরানারই আর এক দিকপাল উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে; যিনি ছিলেন রশিদের দাদু। রশিদের মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের কাছ থেকেও তালিম নিয়েছেন রশিদ।
মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইলেও ফিউশন বা বলিউড এবং টলিউডের ছবিতে বহু জনপ্রিয় গানও গেয়েছেন শিল্পী রশিদ খান। ১০-১১ বছর বয়সে কলকাতা চলে আসেন, সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির স্কলারশিপ নিয়ে দাদু নিসার হুসেনের কাছে গান শেখা শুরু। তার পর থেকে গিয়েছেন কলকাতাতেই।
READ MORE
Interview: Ustad Raza Ali Khan
শিল্পীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গঙ্গাসাগর সফর থেকে হাসপাতলে পৌঁছান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রয়াত শিল্পীর পরিবারের সঙ্গে আলোচনা শেষে জানান, বুধবার সকালে শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে রবীন্দ্র সদনে, শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে। তারপর গান স্যালুট। শেষ যাত্রায় টালিগঞ্জে নিজের বাড়ি ঘুরে শিল্পীর মরদেহ সমাধিস্থ করা হবে টালিগঞ্জের কবরস্থানে।
শিল্পী উস্তাদ রশিদ খান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, পদ্মবিভূষণ, পদ্মশ্রী সম্মান যেমন পেয়েছেন, তেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মান।
মাত্র ১০-১১ বছর বয়সে দিল্লির কনসার্টে গান গেয়েছিলেন রশিদ খান। প্রায় পাঁচ-ছ’হাজার দর্শকের মাঝে গাইতে একটু ভয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বয়সেই তাঁর বন্দিশ শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভিত হলেও বলিউড ও টলিউডের একাধিক সিনেমায় গান গেয়েছেন উস্তাদ রশিদ খান। জব উই মেট সিনেমায় আওগে যব তুম সজনা গানের মাধ্যমে সারা দেশের মন জয় করে নেন তিনি। শাহরুখ খানের মাই নেম ইজ খান সিনেমায় আল্লা হ্যায় রহেম গানটি গেয়েছেন শিল্পী। মান্টো’র বোল কে লব আজাদ হ্যায় থেকে মিতিন মাসি’র বরসাত সাওয়ান, প্রত্যেক গানে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন শিল্পী উস্তাদ রশিদ খান।
এদিকে, প্রথম বার তাঁর গান শুনে উস্তাদ রাশিদ খান সম্পর্কে ভীমসেন জোশী বলেছিলেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার ভবিষ্যৎ পেয়ে গিয়েছে। সেই ভবিষ্যৎ’ই অকালে অতীত হয়ে গেলেন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।
রশিদের প্রথম তালিম তাঁর মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের থেকে। খুব অল্প বয়সে রশিদকে মুম্বইয়ে নিয়ে যান তাঁর মামা। সেখানে এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু সেখানে কিছু ভাল লাগে নি রশিদের। ফলে ফিরে আসেন বদায়ূঁ। বদায়ূঁতে ফিরে রশিদ তালিম নেওয়া শুরু করেন রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার দিকপাল উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে; যিনি ছিলেন সম্পর্কে রশিদের দাদু।
ছোটবেলায় আর পাঁচজন শিশুর থেকে আলাদা ছিলেন না রশিদ খান। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলায় রেওয়াজ করতে চাইতেন না। বেশি ক্ষণ রেওয়াজ করলে বিরক্ত হয়ে যেতেন। মনে হত, গানবাজনা ছেড়ে দেবেন। অনেকে বলতেন, গলা ভাল, গান করো। কিন্তু, রশিদ খানের ইচ্ছে হত না। কিন্তু, দাদু নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। খুব রাগী। রেওয়াজে ভুলচুক হলে মারধর তাই তাঁর ভয়েই রোজ নিয়ম করে রেওয়াজ করতে হত।
১৯৭৮ সালে নিসার হোসেন খাঁ-সাহিব চলে আসেন কলকাতায়। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির গুরু হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সঙ্গে আসেন রশিদ খানও। পরীক্ষা দেন এবং স্কলার হিসাবে দাদুর কাছে শিক্ষা শুরু করেন। সে সময়ে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এ কানন, মালবিকা কানন, বিজয় কিচলু, ভিজি যোগ এবং দীপালি নাগের মতো ব্যক্তিত্বেরা। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে রশিদ বলেছিলেন, প্রথম রাগ শেখা ভৈরব। কয়েক মাস শুধু সা বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন দাদু। তার পর কয়েক মাস ধরে চলত খরজে রেওয়াজ। অতঃপর দ্রুতলয়ে বিভিন্ন বন্দিশ শেখাতেন নিসার হোসেন। বিলম্বিত শেখা তখনও শুরু হয় নি।
সব মিলিয়ে, দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে রশিদ খানের আত্মপ্রকাশের পথ মোটেও সহজ ছিল না। রশিদের নিজের ঘরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বোলতান; যা রশিদের গায়কিতে শেষ দিন পর্যন্ত ধরা দিত। সেই সঙ্গে ছোট ছোট সরগম করে বন্দিশের মুখড়াতে ফেরার যে শৈলী, তা-ও রপ্ত করেছিলেন। ফলে রশিদ খানের গানে যেমন নিসার হোসেন খাঁ-সাহিবের বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ করে স্বকীয় ছাপ আনার চেষ্টা করতেন তিনি। সেই সঙ্গে তাঁর গানে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে তারানা; যা তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। কারণ, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব তারানা গায়নকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কীভাবে রেওয়াজ করা উচিত, সে সম্পর্কে রাশিদের ধারণা পরবর্তী কালে অবশ্য খানিক বদলেছিল। এক সাক্ষাৎকারে উস্তাদ রশিদ খান বলেছিলেন, চল্লিশ দিনের চিল্লা, বারো ঘণ্টার রেওয়াজে তিনি বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করতেন শিল্পীদের প্রতি ঈশ্বরের ইঙ্গিত থাকে। তার জোরেই তাঁর মতো শিল্পীরা গানবাজনা করেন। ফলে উস্তাদ রশিদ খান শুধু রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিক্ষাতেই আবদ্ধ রাখেন নি নিজেকে। অন্য সব ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীদের ভালটাও নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলেছিলেন, গুরু উস্তাদ নিসার হুসেন সব সময় বলতেন, আর যা-ই করো, ভুলেও কাউকে কোনও দিন হিংসে কোরো না। হিংসে করলে সঙ্গীতের মৃত্যু অনিবার্য। সাধনা করতে করতেই নিজস্ব গায়কি তৈরি হয়।
উস্তাদ রশিদ খানের মৃত্যুতে শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত বলেন:
LISTEN TO
Swagata Lakkhi on Ustad Rashid Khan
02:28
LISTEN TO
Saikat Mitra on Ustad Rashid Khan
01:10
LISTEN TO
Jaya Sil on Ustad Rashid Khan
01:27
প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার, বিকাল ৩টায়, এসবিএস পপদেশীতে আমাদের অনুষ্ঠান শুনুন, লাইভ।
কিংবা, পুরনো সময়সূচীতেও আপনি আমাদের অনুষ্ঠান শোনা চালিয়ে যেতে পারেন। প্রতি সোম ও শনিবার, সন্ধ্যা ৬টায়, এসবিএস-২ এ।
৫ অক্টোবর ২০২৩ থেকে নতুন চ্যানেলে ও নতুন সময়ে SBS Bangla Credit: SBS