বেশ কিছু দিন ধরেই সিওপিডির সমস্যায় ভুগছিলেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অগণিত গুণীজন।
শোকস্তব্ধ পাঠকরাও। বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় ঈদ সংখ্যায় অবশ্যই পাওয়া যেত সমরেশ মজুমদারের লেখা। ঢাকার সাহিত্য অঙ্গনে আড্ডাবাজ, আমুদে মানুষ হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন খুব।
সাতকাহন থেকে গর্ভধারিনী, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, অর্জুন, মেজরের অ্যাডভেঞ্চার-সহ বাংলা সাহিত্যের একের পর এক ক্লাসিক সৃষ্টির রূপকার চলে গিয়েছেন চিরঘুমের দেশে।
কালবেলা নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। আরেক লেখা দৌড়ও সিনেমা হয়েছে। কলকাতার উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা স্লোগান, বিপ্লব, রক্ত, বোমা ও প্রেমের এক তোলপাড় ফেলা কাহিনীর জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন সমরেশ মজুমদার।
সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪৪ সালে। শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটায়। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন সমরেশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। শিক্ষা সূত্রেই শহর কলকাতার সঙ্গে পরিচয়। শুরুতে ছোটগল্প লিখেই খ্যাতি। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে দৌড় উপন্যাস ছাপা হয়েছিল একটি বাণিজ্যিক পত্রিকায়।
বলা হয়, কম বয়েসের দেখা বিপ্লবের স্বপ্ন, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও ছেড়ে যান নি সমরেশ মজুমদার। অচিরেই বাংলা সাহিত্যে বৃহত্তর পাঠক এবং সমালোচকের নজর কাড়েন সমরেশ। তারপর অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, রম্য, ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর উপন্যাস ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ বাংলা সাহিত্যে তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে বলে মনে করা হয়। যার অন্তিমপর্ব, মৌষলকাল।
আসলে বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পর, নতুন মুখ সেভাবে চোখে পড়ে নি ১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত। বাংলা গদ্যসাহিত্যে তখন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। হাংরি বা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কথাসাহিত্যকে তার চেনা খোলস ত্যাগ করে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। অতি বামপন্থী রাজনৈতিক ঝঞ্ঝায় টালমাটাল পশ্চিমবঙ্গ। বদলাচ্ছে পারিবারিক পরিসরও। এমন পরিস্থিতিতে যুবক সমরেশ লিখে ছিলেন, বড় পাপ হে-র মতো এক গল্প। তিন বিগতযৌবনা দেহোপজীবিনীর অন্ধকারের আখ্যান ছাপা হয়েছিল দেশ-এর মতো পত্রিকাতেই। অগ্রজ লেখকসহ পাঠককুলের সেই গল্পই সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল।
তারপর, নকশালপন্থী আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে মাথায় রেখেই সমরেশ মজুমদার লিখতে শুরু করেন তাঁর কালবেলা ট্রিলজি। প্রথম উপন্যাস উত্তরাধিকার-এ উত্তরবঙ্গের মফস্সলে অনিমেষ নামের এক কিশোরের বেড়ে ওঠার সেই কাহিনি স্পর্শ করে প্রায় সব শ্রেণির পাঠককেই। বদলে যাওয়া সময়ের এক সুবিশাল আলেখ্যকে মাথায় রেখেই কলম ধরেছিলেন সমরেশ মজুমদার।
ট্রিলজির পরের ভাগ, কালবেলা তুলে ধরে নকশালপন্থী আন্দোলনে অনিমেষের জড়িয়ে পড়ার কথা, তার প্রেমিকা মাধবীলতার কথা। যে সময় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় বার হচ্ছে, তখন আন্দোলন আর নেই। আপাতত শান্তিকল্যাণের এক কাল পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু সেই আখ্যানই যেন সদ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে জাগিয়ে তুলেছিল তার ঠিক পূর্ববর্তী কালান্তরের পর্বকে। বলা হয়, ১৯৭০-এর সেই উত্তাল সময়ের স্মৃতির সংরক্ষণের কাজ করেছিল কালবেলা।
আবার, কালবেলা’র পরবর্তী পর্ব, কালপুরুষ স্বপ্নভঙ্গের আলেখ্য। যেখানে বিপ্লবী অনিমেষের জেল থেকে ফেরা এবং এক বস্তি অঞ্চলে মাধবীলতা আর পুত্র অর্ককে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কাহিনি। অর্কের মাথায় তখন কাজ করছে আপাতত শান্তিকল্যাণের কৃত্রিম স্থিতির বিরুদ্ধে জমে থাকা অগণিত ক্ষোভ। ১৯৮০-র দশকে সেই ক্ষোভ সংবেদনশীল বাঙালি অনেক কিশোরেরই ভিতরে জ্বলছিল। কালপুরুষ হয়তো সে অর্থে এক স্বপ্নরাজ্যের ইশারা রাখে।
শুধু লেখক নয়, চিত্রনাট্যকার হিসাবেও বাংলা টেলিভিশনে দাগ কেটে গেছেন সমরেশ মজুমদার। জ্যোছন দস্তিদারের পরিচালনায় বাংলা ধারাবাহিক। সেই সময় ধারাবাহিকের কাহিনিকার হিসেবে আবির্ভাব সমরেশের। তেরো পার্বণ-এর লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাঙালি গেরস্থালির অঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। টেলিভিশনে, বাংলা সিরিয়ালের স্বর্ণযুগ বলতে জ্যোছন দস্তিদার-সমরেশ মজুমদার পর্বের কথাই বাঙালির স্মৃতিতে ধরা রয়েছে। সমরেশ এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যিনি সদ্য আগত এক শিল্পমাধ্যমেও সফল। পরবর্তী কালে তাঁর আর এক সাড়া জাগানো উপন্যাস সাতকাহন-ও ধারাবাহিক হিসেবে সফল হয়েছে।
কিশোরদের মনও জয় করে নিয়ে ছিলেন সমরেশ মজুমদার তাঁর অর্জুন-কাহিনির মধ্যে দিয়ে। যে অর্জুন উত্তরবঙ্গের এক যুবক। ক্রমেই যে জড়িয়ে পড়ে গোয়েন্দাগিরিতে। অর্জুনের কাহিনি কখনও কখনও স্বাভাবিক গোয়েন্দা গল্পের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কল্পবিজ্ঞানের জগতেও পা রেখেছে। কিন্তু, কলকাতাকেন্দ্রিক গোয়েন্দাদের ভুবনে অর্জুন একাই মফস্সলের প্রতিনিধি। পরবর্তী সময়ে, নবকুমার সিরিজেও নিজের কথাই কি ফিরে বলছিলেন সমরেশ মজুমদার? কলকাতা, ফিল্মজগৎ ইত্যাদির অভিজ্ঞতাকেই কি নতুন করে বুনছিলেন, স্বর্গছেঁড়া চা-বাগান থেকে আগত যুবক, নবকুমার, কিছুদিন আগেও আড্ডায় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দোলিত করে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা অডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: