ভারত ২০১৯: রাজনৈতিক -সামাজিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ
রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ২০১৯ ভারতের জন্যে ছিল রীতিমত ঘটনাবহুল। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দল বিজেপি। মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে ফের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরেছে বিজেপি। ১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে প্রায় দেড় মাস ধরে ৭ দফায় ভোটগ্রহণ পর্বে বিজেপি একাই দখল করেছে ৩০৩ টি আসন।পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে ১৮ টি আসন। গত সাড়ে তিন দশকে প্রথমবার এরকম বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কোনো দল। আর ভোটে এই ফলে কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে ধরাশয়ী হতেই দলের সভাপতির পদ ত্যাগ করেছেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসের সভাপতির পদে অন্তর্বর্তী দায়িত্বে ফিরেছেন সোনিয়া গান্ধী।
বছর শুরুর দু’মাসের মধ্যে গোটা দেশ চমকে উঠেছিল পুলওয়ামা হামলা-বালাকোট বিমান হানার ঘটনায়। ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় জইশ জঙ্গিরা। নিহত হন ভারতের ৪০ জওয়ান। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট বলে অভিযোগ ওঠা জঙ্গিদের ওই আক্রমণের পাল্টা আঘাত হানার দাবিতে গর্জে ওঠে গোটা দেশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে জঙ্গি শিবিরে হামলা চালায় ভারতের বায়ুসেনার মিরাজ ২০০০ ফাইটার জেট। পাকিস্তানের সেনার হাতে বন্দি হন বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। ভারতের চাপে তাঁকে শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।
এর পরই অসমে নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি নিয়ে তোলপাড় হয়। গোটা দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা।তাতে অসমের ১৯ লাখ (১.৯ মিলিয়ন) মানুষ বাদ পড়ে যান। বিক্ষোভ শুরু হয় রাজ্যে শাসকদল বিজেপির অন্দরে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ে যায় কেন্দ্র সরকার। পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়।অন্যদিকে, বহু বছর ধরেই শাসকদল বিজেপি-র নির্বাচনী এজেন্ডায় ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদের বিষয়টি। নিরঙ্কুশ সংখ্যা-গরিষ্ঠতা নিয়ে সেটাই প্রথমে করে ফেলেছে বিজেপি। ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ করার কথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পাশাপাশি তিনি জম্মু ও কাশ্মীরকে ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার কথাও ঘোষণা করেছেন। এতে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে। রাজ্যে বিপুল সংখ্যক সেনা নামিয়ে বিক্ষোভ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে সরকার, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী-সহ অনেক নেতা-নেত্রীকে।
Indian Prime Minister Narendra Modi addresses a rally to launch Bharatiya Janata Party's (BJP) campaign for the upcoming Delhi assembly elections. Source: EPA
এর মধ্যেই স্বাধীনতা পরবর্তি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা, অযোধ্যা জমি বিতর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরিয়েছে। ৯ নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের তত্কালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে বেঞ্চে অযোধ্যা মামলার রায় দিয়েছেন। অযোধ্যা বাবরির বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রাম জন্মভূমি ন্যাসকে দেওয়ার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অযোধ্যার মধ্যেই মসজিদ তৈরির জন্য ৫ একর জমি দেওয়া হয়েছে মুসলিম পক্ষকে। বছরের শেষ দিকে, একই দিনে, করতারপুর করিডোর খুলে গিয়েছে। ভারতের শিখ পুণ্যার্থীদের বহু দিনের দাবি ছিল এই করতারপুর করিডোর। ৯ নভেম্বর তার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রথম ব্যাচে ভারত থেকে গুরুদ্বার দরবার সাহিবে গিয়েছেন ৫০০ জন শিখ পুণ্যার্থী।
কাকতালীয়ভাবে এরপরই বছরের শেষ দিকে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা হারিয়েছে বিজেপি। শরিকি দ্বন্দ্বে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা হারিয়েছে বিজেপি। বহু নাটকের পর শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-এনসিপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছে শিবসেনা। উদ্ধব ঠাকরেদের ৫০-৫০ ফর্মুলা মেনে না নেওয়াতেই বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছে ঠাকরে পরিবারের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন উদ্ধব ঠাকরে। এই নিয়ে গত এক বছরে ৪ রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছে বিজেপি।বছর শেষে নির্ভয়া-কাণ্ডের মতোই দেশ আলোড়িত হয়েছে হায়দরাবাদ এনকাউন্টার ঘটনাকে ঘিরে। ২৮ নভেম্বর ভোরে নজিরবিহীনভাবে হায়দরাবাদে পশু চিকিত্সকের ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তদের এনকাউন্টারে গুলি করে মারে তেলঙ্গানা পুলিস। অভিযোগ, ধর্ষণস্থলে অভিযুক্তদের নিয়ে যায় পুলিস। সেখানেই ঘটনার পুনর্নিমাণের চেষ্টা করা হয়। অভিযোগ, তখনই হাতিয়ার ছিনিয়ে পুলিসের ওপরে হামলার চেষ্টা করে ৪ অভিযুক্ত। তখনই চরম পদক্ষেপ নেয় পুলিস।
Indian paramilitary soldiers stand guard in Srinagar, Kashmir, 17 October 2019. Source: EPA
আর বছর শেষে দেশ তোলপাড় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ইস্যুতে। আগস্ট মাসে অসমে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করে ধাক্কা খেয়েছিল কেন্দ্র সরকার। নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ে ছিলেন ১৯ লাখ (১.৯ মিলিয়ন) মানুষ। অবস্থা সামাল দিতে ১১ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করেছে কেন্দ্র সরকার। আইন অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্থান ও বাংলাদেশ থেকে আগত অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। এর পরই দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মের ভিত্তিতে কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অভিযোগ, এতে দেশের সংবিধানের মূল কাঠামোতে আঘাত হানা হচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী বিক্ষোভে এখন প্রর্যন্ত শুধু উত্তরপ্রদেশেই নিহত হয়েছেন ১৯ জন। বিক্ষোভ হয়েছে দিল্লি, কর্ণাটক, বিহার, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের অধিকাংশ রাজ্যে।
সব মিলিয়ে ভারতে বছরের শুরু ছিল জাতীয়তাবাদ ইস্যু। আর বছর শেষে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে নাগরিকত্বে। আর অর্থনীতি নিয়ে বাড়ছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ।