বাংলাদেশের ভাষা শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে আন্দোলন হয়। পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার-সহ নাম না জানা ভাষা সৈনিকেরা।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকোর ৩০তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাশ হয়। এর পরের বছর থেকে পৃথিবীর ১৮৮ টি দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন হওয়া শুরু হয়।ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাই কমিশন এবং বাংলাদেশী কমিউনিটি ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার একসঙ্গে উদযাপন করছে ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি অস্ট্রেলিয়ায় কর্ম-দিবস হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যরা ও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে তাদের সুবিধাজনক সময়ে, যেমন, রবিবারে।
Dr Ajoy Kar. Source: Supplied
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাভাষীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে কী ভাবছেন তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।
মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ কনসার্ভেশন মুভমেন্টের ক্যানবেরার দায়িত্বে রয়েছেন ড. অজয় কর। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বলা হলে বাংলাভাষী হিসেবে তিনি গর্ব বোধ করেন। তিনি বলেন,
“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা যখন বলা হয় তখন সাথে সাথে বাঙালি হিসেবে গর্বে বুকটা ভরে উঠে। কারণ, এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মূলে যে ভাষাটা ছিল সেটা হলো বাংলা ভাষা।”ব্রিসবেনের জ্যোতিষ দাশ জয় বলেন, মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই দিবসটি বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়।
Jutish Das Joy. Source: Supplied
TAFE NSW এর অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স-এর শিক্ষক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মাহবুব হাসান বাহার সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষকতা করেন। তিনি বলেন, আসলে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের গর্ব। আমরা যখন দেশের বাইরে এসে অন্য ভাষায় কথা বলি তখন মাতৃভাষার গুরুত্ব দ্বিগুণ নয়, চারগুণ হয়ে যায়।
“আসলে একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের গর্ব, ভাষা রক্ষার্থে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম ১৯৫২ সালে, চাপ থাকা সত্ত্বেও ভাষাটা রক্ষা করতে পেরেছি জীবনের বিনিময়ে।এটা আসলে আমাদের অন্য অনুভূতির জায়গা। বিদেশ বিভুঁইয়ে আমরা যখন অন্য ভাষায় কথা বলি, সেখানে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। তাই এই ভাষাকে রক্ষা করতে আমাদের কিছু করণীয় থাকলে তা করতে আমরা সবসময়েই উদগ্রীব থাকি।”
মেলবোর্নের আইনজীবি নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির গুরুত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের জীবনে মায়ের ভাষার যে গুরুত্ব তা তুলে ধরা। তিনি বলেন,
“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাঙালিদের কাছে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা জানি যে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়, মায়ের ভাষার যে গুরুত্ব সেটা তুলে ধরার জন্য।”নুরুল ইসলাম মানিক আরও বলেন, এই দিনটি পালন করা হয় এজন্য যে, এ দিনটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মায়ের ভাষা হচ্ছে এমনই একটি ভাষা যার মাধ্যমে আমরা কথা বলা শিখি, চিন্তা করি এবং স্বপ্ন দেখি।
Mahbub Hassan Bahar, CA. Source: Mahbub Hassan Bahar, CA.
“এইদিনটি উদযাপন করা হয় এজন্য যে, মায়ের ভাষা এমন একটি ভাষা যে ভাষায় আমরা কথা বলতে শিখি। যে ভাষার মাধ্যমে আমরা চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি, এই ভাষাটা প্রত্যেকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, এবিষয়টিই পরবর্তী প্রজন্মকে পৌঁছে দেয়ার জন্য এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।”
নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় মাতৃভাষায় কথা বললে কেউ বৈষম্যমূলক আচরণ করবে, সেটা যেন কেউ মনে না করে সেজন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করেন সিডনির সংস্কৃতি-কর্মী নুসরাত জাহান স্মৃতি। শোকের সাথে আনন্দের একটি সংমিশ্রণ বলে এই দিনটিকে অভিহিত করেন স্মৃতি।
Nurul Islam Manik. Source: Supplied
নিউ সাউথ ওয়েলসের ডাবোর অধিবাসী রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী শিবলি চৌধুরী বলেন, মাতৃভাষা প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পার্থের বাসিন্দা এবং সংস্কৃতি কর্মী বিশ্বজিৎ বোস বলেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ আনন্দ-বেদনার অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে।
“মানুষ যখন প্রথম কথা বলা শিখে, তারপর প্রথম যে ভাষাতে কথা বলে সেটাই তার মাতৃভাষা, এবং তার মনের বেদনা, আনন্দ, হাসি-কান্না যার প্রকাশ যার মধ্যে দিয়ে হয় সেই মাতৃভাষা যদি সে না প্রকাশ করতে পারে তাহলে তার ভাবের প্রকাশ সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাহত হয়। অস্ট্রেলিয়ার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানকার আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।”অ্যাডিলেইডের বাসিন্দা এবং বাংলাদেশ ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তা ফারহানা আজাদ। ভাষাকে তিনি আত্ম-পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন,
National Party of Australia activist Mr Shibli Chowdhury with NSW Premier Gladys Berejiklian. Source: Supplied
“ভাষাকে আমরা দেখি শিল্পসাহিত্য এবং সংস্কৃতির মাধ্যম হিসেবে। আমি আমার ভাষাকে দেখি আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে হিসেবে। তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজ ভাষাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন প্রচণ্ডভাবে জরুরি।”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে মানুষ এখনও তেমন একটা সচেতন নয় বলে মনে করেন মাহবুব বাহার। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এত বড় একটা অর্জন, এটা আমরা ঠিকমতো মার্কেটিংই করতে পারি নি।
মাহবুব বাহার আরও বলেন, এদেশে আগামী প্রজন্মের জন্য এর ব্যাপক প্রসার হওয়া দরকার।
ক্যানবেরার ড. অজয় কর বলেন, দ্বি-ভাষিক পরিবারগুলোর ছেলে-মেয়েরা সাধারণত অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে ভাল রেজাল্ট করে।
“বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাই-লিঙ্গুয়াল যে-সমস্ত ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েরা আছে তারা তাদের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষাগুলো যখন হয় সেখানে তারা সাধারণত সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করে।”প্রবাসে নতুন প্রজন্মকে তাদের মাতৃভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার নুরুল ইসলাম মানিক।
Nusrat Jahan Smriti. Source: Supplied
“বাবা মা হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে, আমরা যাতে বাড়িতে কথা বলার জন্য মাতৃভাষা ব্যবহার করি, ওই অভ্যাস তৈরী করি। তা না হয়ে এই ভাষা আমরা তাদের মধ্যে জাগরুক রাখতে পারবো না। এশিয়ান কমুনিটির বাবা-মায়েরা বাড়িতে সন্তানদের সাথে মাতৃভাষায় কথা বলে।”
অস্ট্রেলিয়ায় নুসরাত জাহান স্মৃতির পরিবারের সবাই ঘরে-বাইরে ভাষার চর্চা করেন এবং তার ছেলে-মেয়েরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারে।
সন্তানদেরকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও শেখাচ্ছেন শিবলি চৌধুরী। কেউ যেন তার মাতৃভাষা ভুলে না যায়, তার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
বিশ্বায়নের এই যুগে সন্তানদের নিজ ভাষার তাৎপর্য ধরে রাখার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ফারহানা আজাদ।“আর এটা আমাদের জন্য যতই গৌরবের ততই আমি আশংকিত যে বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের সন্তানেরা নিজ ভাষার তাৎপর্য ধরে রাখতে পারছে কিনা, তারা কতটুকু এই ভাষা চর্চ্চা করছে, আর সেই চর্চ্চার জন্যই এই দিবসের একটি বিশেষ তাৎপর্য্য রয়েছে।”
Farhana Azad. Source: Supplied
ফারহানা আজাদ আরও বলেন, মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে প্রবাসে কমিউনিটি স্কুলগুলো ভাল ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যও প্রবাসীদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন ড. অজয় কর।
অস্ট্রেলিয়াকে মাল্টি-কালচারাল কান্ট্রি বলে উল্লেখ করে স্মৃতি বলেন, এখানে প্রত্যেকেই তার ভাষার প্রতি সম্মান রেখেই ভাষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে পার্থের বিশ্বজিৎ বলেন, এর গুরুত্ব অপরিসীম।
“আমরা যখন পার্থে এটা (মাতৃভাষা দিবস) চালু করি তখন এখানকার মিনিস্টাররাও স্বীকার করেন যে মাতৃভাষার চর্চ্চার গুরুত্ব অপরিসীম। মাতৃভাষা ছাড়া আপনি আপনার মনের কথাটা অন্য ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না।”বিশ্বজিৎ আরও বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন আমাদের অনুষ্ঠানে, এছাড়াও অন্য ভাষাভাষীরাও অংশগ্রহণ করেন। এখানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিতর্কে অংশ নেয়, তাছাড়া এবছর ক্ষুদ্রাকারে বইমেলারও আয়োজন করা হয়েছে।
Biswojit Bose Source: Supplied
ব্রিসবেনের জ্যোতিষ দাশ জয় বলেন, প্রবাস থেকে অবশ্যই আমাদেরকে এই দিবসটি পালন করা উচিত।
নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, মেলবোর্নে তারা একটি স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
“পার্মানেন্ট শহীদ মিনার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি উইদিন নেক্সট ইয়ারের মধ্যে আমরা একটা ভাল রেজাল্ট পাব এখানে।”
প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।