এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে যেভাবে নিজের যত্ন নিতে হবে - পর্ব ৩

Hand holding a yellow endometriosis awareness ribbon over blue sky

A yellow ribbon is the emblem for endometriosis awareness, especially during March which is endometriosis awareness month. Source: iStockphoto / ThitareeSarmkasat/Getty Images/iStockphoto

যদিও অনেকেই এর মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের কথা শুনেছেন, তবে এই রোগ নিয়ে অনেক তথ্যই এখনও অজানা এবং অনেকের মধ্যেই এই রোগ সম্পর্কে বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় আট লক্ষ ৩০ হাজার নারী এন্ডোমেট্রিওসিসে ভুগছেন। এই রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ার জন্যে অনেক রোগীকেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এই মুহূর্তে এ রোগের কোনো প্রতিকার জানা নেই। তিন পর্বে ভাগ করা এই সিরিজের চূড়ান্ত পর্বে আমরা জানতে পারব যে কীভাবে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি চিকিৎসা-পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যেতে পারে।


এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীদের জন্যে চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে রোগটি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারা।

একবার সেটি করা হয়ে গেলে তারপরে মূল চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে এবং এই রোগের উপসর্গসহ কীভাবে জীবনযাপন করা যায় তা জেনে নিতে হবে।
রয়্যাল উইমেনস হসপিটালের অ্যালেক্স অ্যাডেসের মতে, চিকিৎসার জন্যে রোগীর পরিস্থিতি অনুযায়ী ওষুধ বা অস্ত্রোপচার, অথবা দুটিরই প্রয়োজন হতে পারে।

“এর কোনো একক চিকিৎসা-পদ্ধতি নেই। এটি এমন কিছু নয় যে একটা ওষুধ খেয়ে বা একটা অস্ত্রোপচার করেই এর চিকিৎসা করে ফেলা যায়। সুতরাং যাদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন তাদেরকে অস্ত্রোপচার, যাদের ওষুধ দেয়া প্রয়োজন, তাদের সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। কোনো কোনো সময়ে অন্য কিছু উপায়ও এর সাথে যুক্ত করা দরকার হতে পারে। এ কারণেই আমরা এটিকে মাল্টিডিসিপ্লিনারি চিকিৎসা বলে থাকি,” তিনি বলেন।

এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতিটি রোগীদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধারার বিশেষজ্ঞরা যেমন, ব্যথা বিশেষজ্ঞ, পেলভিক ফিজিওথেরাপিস্ট, বিকল্প ওষুধ, জিপি ও মনোবিজ্ঞানী, এবং সেইসাথে গাইনোকোলজিস্টদেরও অংশগ্রহণের দরকার হতে পারে।
এন্ডোমেট্রিওসিস অস্ট্রেলিয়া-র অ্যালেক্সিস উলফ ব্যাখ্যা করে বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য হল উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণ করা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা আরও উন্নত ও নিশ্চিত করা।

“কারও কারও জন্যে হয়তো হরমোনাল চিকিৎসা কাজে লাগতে পারে। আবার অনেককেই অস্ত্রোপচার করাতে হতে পারে। কেউ কেউ জীবনযাত্রার ধরন পালটে ভাল থাকার চেষ্টা করেন। যেমন, খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়াম। আবার অনেকে আকুপাঙ্কচারও করান। একেবারে সুস্থ হয়ে যাওয়ার যেহেতু কোনো উপায় এখনও জানা নেই, তাই এরকম বিভিন্ন উপায় অনুসরণ করে ভাল থাকার চেষ্টা করতে হবে,” তিনি বলেন।
এন্ডোমেট্রিওসিস বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুপারের মতে, যারা শীঘ্রই গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছেন, এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ হরমোনের চিকিৎসা তাদের জন্যে উপযুক্ত নয়।

তিনি বলেন, “হরমোনাল চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত সব উপাদানই কন্ট্রাসেপ্টিভ উপাদান। সুতরাং গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের জন্যে এটি মোটেও উপযুক্ত নয়।”

তবে উপযুক্ত ও সঠিক চিকিৎসার সাথে সাথে আরও কিছু উপায়ে এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সক্ষম হতে পারেন।

“এমন খাদ্য বেছে নিতে হবে যাতে পেটে গ্যাস এবং জ্বালাপোড়া হবে না। অবসাদ, নিদ্রাহীনতা, এসবই ব্যথার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে তাই এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার ঠান্ডা বা উষ্ণ গোসল নেয়া, এবং আকুপাঙ্কচারও সাহায্য করতে পারে। এগুলো সবই অনেকের জন্যেই বেশ কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ বলা যায়, সবার জন্যে অস্ত্রোপচারই একমাত্র উপায় নয়,” তিনি আরও যোগ করেন।
উপযুক্ত সমর্থন পেলে বেশিরভাগ মানুষই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগসহ জীবন ধারণে অভ্যস্ত হতে পারেন।

কার্যকর চিকিৎসা-পদ্ধতি সাময়িকভাবে এর উপসর্গগুলি হ্রাস করতে পারে। কিন্তু কোনো চিকিৎসাই এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে পারে না।

এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত কেট স্যাগার্স নিজেও জানেন, এই উপসর্গগুলি আবারও ফিরে আসতে পারে।

কেট বলেন, “মাঝে মাঝেই ব্যথা ফিরে আসতে পারে। কিছুদিন আগে আমার ব্যথা এত তীব্র হয়েছিল যে আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ব্যথা নেই। সুতরাং যে কোনো পরিস্থিতির জন্যেই প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।“

এন্ডোমেট্রিওসিস অস্ট্রেলিয়া দ্বারা পরিচালিত গবেষণা অনুসারে, রোগীদের শতকরা ৭০ ভাগ জানিয়েছেন যে ব্যথার তীব্রতার কারনে তাদেরকে অবৈতনিক ছুটি নিতে হয়েছিল।

মি. উলফ বলেন, “এই রোগে আক্রান্তদের আমরা এন্ডো ওয়ারিয়র (যোদ্ধা) বলে ডাকি। প্রতি তিন জনে এক জন এন্ডো ওয়ারিয়রকে কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে এই রোগের কারণে। প্রতি ছয় জনে এক জন রোগীকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলি খুবই দুঃখজনক। এ কারণেই আমরা কর্মক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস প্রোগ্রাম চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যেন রোগী ও তাদের নিয়োগকারী, প্রত্যেকেই এই সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে, এবং একে অপরকে সহায়তা করতে পারে।“

প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে আরও গবেষণা এবং বৃহত্তর সচেতনতার জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। অ্যালেক্স অ্যাডেস মনে করেন যে ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে।

তিনি বলেন, “বিশ্বজুড়ে এখন এই বিষয়ে গবেষণা বাড়ছে, বৈশ্বিক বিভিন্ন সম্মেলনে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবচেয়ে আনন্দের দিন হবে সেটি, যেদিন সত্যিই এই রোগের জন্যে কোনো ওষুধ আবিষ্কার হবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা এখনও সেই দিন থেকে অনেক দূরে আছি।“

মাইকেল কুপার এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন।

তিনি জানান, একটি ডাটাবেজ তৈরির জন্যে অনেক অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যেন এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে আরও তথ্য ও গবেষণা করা সম্ভবপর হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস যুক্তরাজ্যের সিইও এমা কক্স বলেছেন যে "এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্তদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আশার আলো" দেখাতে আরও গবেষণা অত্যাবশ্যক।

এবং কেট স্যাগার্সের মতো নারীদের জন্যে এই মুহূর্তে আশা-ই প্রয়োজন। আশা এবং সমর্থন।

“এ বিষয়ে জড়তা ভেঙ্গে আমাদের আলোচনা করতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের পরিচিত গন্ডির ভেতরের কারো না কারো এন্ডোমেট্রিওসিসে ভোগার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং এ বিষয়ে আমরা যদি সহজে আলোচনা করতে পারি, তাহলেই কেবল এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। আমার নিজের জন্যেও কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলাই সবচেয়ে কঠিন ছিল,” তিনি বলেন।
মাইকেল কুপার বিশ্বাস করেন যে এন্ডোমেট্রিওসিসের রোগীরা তাদের পছন্দ মত জীবন যাপন করতে সমর্থ হবেন।

“আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী যে রোগীরা বিভিন্ন জটিলতা পার হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীরা তাতে সমর্থ হবেন, এবং অন্যান্যরাও প্রতিদিনকার কাজগুলো সহজে করতে পারবেন। তবে পুরো ব্যাপারটিতে আমাদের একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ‘একটা অস্ত্রোপচার করালেই হবে, বা কোনো অঙ্গ অপসারন করলেই চলবে’- এরকম মনোভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।“

কোনোদিন এন্ডোমেট্রিওসিস পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব হবে কিনা, এ প্রসঙ্গে অ্যালেক্সিস উলফ নিজেকে আশাবাদীদের দলে রাখতে চান।

“আমি আশাবাদী। হয়ত আমাদের প্রজন্ম এটি দেখে যেতে পারবে না, তবে আমি মনে করি, অস্ট্রেলিয়াসহ সারা বিশ্বের নিবেদিত গবেষকদের ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা একদিন এর প্রতিকার খুঁজে পাব। এবং আমরা এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত মানুষদের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে পারব। আমি জানাতে চাই যে এই রোগ নিয়েও একটি মানসম্পন্ন জীবন যাপন করা সম্ভব। এর জন্যে অধ্যবসায় এবং সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু এটি অসম্ভব নয়। শুধু একটু সময় ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন।“

*বিশেষ দ্রষ্টব্য:

এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত নারী, কিশোরী ও যারা লিঙ্গ বৈচিত্রের অন্তর্ভুক্ত, তাদের সকলের বিষয়ে স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে যে, যারা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং যারা নন-বাইনারি, তারা এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত হলেও নারী হিসেবে চিহ্নিত নাও হতে পারেন।

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ার বাটনে ক্লিক করুন।

আগের দু’টি পর্ব শুনুন এখানে: ,

যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে:

কেট স্যাগার্স - মেলবোর্নে বসবাসরত ব্রিসবেনের একজন ৩৩ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান। প্রথম উপসর্গের আট বছর পর ২০০৮ সালে তার এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়ে।

অ্যালেক্স অ্যাডেস - একজন প্রসূতি এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, এন্ডোমেট্রিওসিস বিশেষজ্ঞ এবং রয়্যাল উইমেন্স হাসপাতালের এডভান্সড ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন।

অ্যালেক্সিস উলফ - এন্ডোমেট্রিওসিস অস্ট্রেলিয়ার সিইও, সংস্থাটি এন্ডোমেট্রিওসিসের স্বীকৃতি বাড়ানো, এ বিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম এবং গবেষণার জন্য অর্থায়নে সহায়তা করে।

মাইকেল কুপার - এন্ডোমেট্রিওসিস বিশেষজ্ঞ, এন্ডোস্কোপিক সার্জন এবং সেন্ট লুকস হাসপাতালের গাইনোকোলজির প্রধান।

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share