গত বুধবার বাংলাদেশ সময় বিকাল চারটার দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের অগ্রভাগ বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং সাতক্ষীরায় আঘাত হানে। উপকূলীয় প্রায় সবগুলো জেলাতেই এর প্রভাবে তীব্র বেগে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল। এই ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ ও আশেপাশের জেলাগুলো অতিক্রম করে পাবনা ও রাজশাহী জেলাতেও এর ছাপ রেখে যায়। অবশেষে এটি প্রবল বৃষ্টি ঝরিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়।
এর আঘাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া, আম্পানের সঙ্গে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণেও ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ক্ষেতের ফসল, ফল-বাগান, পুকুরের মাছ, চিংড়ির ঘের এবং কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
প্রকৃত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বাসিন্দা মেসবাহ মুন্না এসবিএস বাংলাকে বলেন, সেখানকার একটি বেড়ি বাঁধ সম্পূর্ণ রূপে ভেসে গেছে।
“স্থানীয় লোকজন আমাদেরকে বলছে যে, তারা ইতোপূর্বে এত বড় জলোচ্ছ্বাস বা ঢেউয়ের ঘটনা দেখে নি।”
“এক ব্যক্তি তার মাকে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, তিনিও গাছ-চাপা পড়ে আহত হয়েছেন এবং বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।”
মেসবাহ মুন্না আরও বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র-সৈকতের নিকটবর্তী অস্থায়ী দোকানপাট বিনষ্ট হয়েছে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, যেমন, ডাব বিক্রেতা, ফুচকা বিক্রেতা, যারা মাছ ও কাঁকড়া ভেজে বিক্রি করেন, তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের পটুয়াখালীর গলাচিপা প্রতিনিধি শঙ্কর লাল দাশ এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“পটুয়াখালি জেলায় দু’জনের প্রাণহানী ঘটেছে। এক জন কলাপাড়া উপজেলায় আরেক জন গলাচিপা উপজেলায়। গলাচিপা উপজেলায় ৫ বছর বয়সী এক শিশু মারা গেছে। শিশুটি তার মায়ের হাত ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিল, এ সময়ে একটি গাছের ডাল তার উপরে ভেঙ্গে পড়ে।
খুলনায় কর্মরত দেবব্রত কুমার মণ্ডল বলেন,
“উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো ভেঙ্গে গেছে এবং লোনা পানি ব্যাপকভাবে প্রবেশ করে চিংড়ি ঘেরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।”
“সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের নরম কাঁকড়ার ব্যবসাও প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
“অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন আছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে জান-মালের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাচ্ছে না।”
স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তাহীনতার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন,
“বাস্তবিক অর্থে আজও টেকসই বেড়িবাঁধ যে কী সেটা এই এলাকার লোক আজও জানে না এবং প্রতি মুহূর্তেই তারা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”
Super Cyclone Amphan hitting West Bengal & Kolkata Source: AAP
বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত
মেসবাহ মুন্না এসবিএস বাংলাকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ চলে যায়। তিনি যখন এসবিএস বাংলার সঙ্গে কথা বলেন, তখন পর্যন্ত সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু হয় নি।
“মঙ্গলবার রাত ১১ টার দিকে আমাদের এখানে বিদ্যুৎ চলে গেছে। এরপর আর এখন পর্যন্ত আমরা বিদ্যুৎ পাই নি। বিদ্যুৎ এখনও চালু করতে পারে নি। এটা আমাদের জন্য একটা বড় ধরনের সমস্যা। এ কারণে আমরা যারা শহরে বাস করি, তারা পানি সরবরাহ সেবা থেকে বঞ্চিত আছি।”
বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মোশারফ হোসেন এসবিএস বাংলাকে জানান,
“এখানে যে ফায়ার সার্ভিস, তারা এই গাছগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করছে এবং অসংখ্য বিদ্যুতের খুটি উপড়ে পড়েছে। এখন গোটা এলাকায় বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন। মানে নেই বললেই চলে। আর, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব খারাপ অবস্থা আর কি।”
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা
মেসবাহ মুন্না এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া বেশিরভাগ মানুষেরা বাড়িতে ফিরে গেছে। শুধুমাত্র, পটুয়াখালীর লালুয়া ইউনিয়নের একটা এলাকা আছে, রামনাবাদ নদীর পাড়ে, যেখানে পায়রা বন্দরের সার্বিক জেটি, ওখানটায় একটা সাইক্লোন সেন্টারে এখনও কিছু মানুষ আছে। ওখানকার মানুষের প্রায় ১৬ টি গ্রাম জলোচ্ছ্বাসের রাতে, মঙ্গলবার রাতেই, আশ্রয় নিয়েছে। কারণ, ঐ এলাকার বাঁধ, বেড়ি বাধ সিডরের পর থেকে মেরামত করা হয় নি।”
বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের একজন প্রতিনিধি মোশারফ হোসেন এসবিএস বাংলাকে জানান,
“কিছু মানুষ যারা পরিবারের প্রধান, তারা অনেকেই নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেছেন। তাদের রেখে আসা সম্পদের কী অবস্থা সেটা দেখার জন্য। আশ্রয়কেন্দ্রের নারী, শিশু এবং বৃদ্ধরা এখনও আছেন। এ পর্যন্ত ১,৬৯,০০০ এর মতো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।”
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কোভিড-১৯ এর জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
“সতর্কতা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় যে, নির্ধারিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে থাকার জন্য। কিন্তু, একটা পরিস্থিতিতে এটা ভেঙ্গে পড়ে। নিরাপদ দূরত্ব কিন্তু তখন আর বজায় থাকে না”, বলেন মোশারফ হোসেন।
আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ সহায়তা, খাবার-দাবার সবাই পাচ্ছে কিনা এ সম্পর্কে মশারফ হোসেন বলেন,
“জী না। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা পায় নি। গতকাল তিনটি আশ্রয় কেন্দ্রে রাতের বেলা কোনো খাবারই পৌঁছায় নি। তবে, দুপুরের দিকে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছিল। আজকে (২১ মে) সকালেও রান্না করা খিচুড়ি দেওয়া হয়েছে।”
শঙ্কর লাল দাশ এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“বেশিরভাগ লোকজন এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। প্রশাসন রেখেছে। যেহেতু তিন নম্বর স্থল নিম্নচাপের সংকেত রয়েছে। এই কারণে বেশিরভাগ লোকজনকে প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে দিয়েছে। একটা অংশ ঘরে ফিরে গেছে। বিশেষ করে কাছাকাছি যাদের বাড়ি-ঘর আছে।”
“সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার-দাবার দেওয়া হয়েছে এবং রোযার সময়ে ইফতার, রাতের খাবার এবং ভোর রাতের সেহরিও প্রদান করা হয়েছে।”
Trees lie uprooted on a highway from heavy winds ahead of Cyclone Amphan landfall in India Source: AP
ফসলি জমি বিনষ্ট
আম্ফানের প্রভাবে বাংলাদেশের ১ লাখ ৭৬ হাজার (১৭৬,০০০) হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের একজন প্রতিনিধি মোশারফ হোসেন এসবিএস বাংলাকে জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে সাতক্ষীরার দ্বীপ এলাকা গাবুরা ও শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর এলাকায় ৯ টির বেশি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ওখানে প্লাবিত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন।
তিনি বলেন,
“ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার পর গতকাল (২০/৫) রাত ৮টার দিকে গাছ চাপা পড়ে একজন নারী নিহত হয়েছেন। সাতক্ষীরা সদরে। আর, সহস্রাধিক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত, দোকান-পাট এবং অসংখ্য গাছপালা ঝড়ে উপড়ে পড়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে ফলজ ও বনজ বৃক্ষ, ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ আছে। রাস্তায় অসংখ্য গাছ পড়ে থাকার কারণে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ।”
“বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় অসংখ্য ফসলী জমি তলিয়ে গেছে এবং সহস্রাধিক মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। গতকাল (বুধবার) রাত দশটার দিকে যে জলোচ্ছ্বাস, বিশেষ করে আশানে উপজেলায় ৬-৭ ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। এতে রাস্তার উপরেও পানি উঠেছে ২-৩ ফুট পর্যন্ত।”
বাংলাদেশে রাজশাহীর পরে সাতক্ষীরায় অনেক আম হয়। আম বাগানগুলো বিনষ্ট হওয়ার বিষয়ে মশারফ হোসেন বলেন,
“এই ঝড়ে সাতক্ষীরার আম বাগানগুলোতে বলতে গেলে আম নেই। আম্রপালি, গোপাল ভোগ, ন্যাংড়া, এ জাতীয় মূল্যবান যে আম, এ আম নেই। গাছগুলো উপড়ে পড়েছে। টোটাল কোনো ফসলই নেই বলতে গেলে।”
শঙ্কর লাল দাশ বলেন,
“মুগডাল উৎপাদনে পটুয়াখালি জেলা সমগ্র বাংলাদেশে শীর্ষে আছে। আম্ফানে মুগ ডাল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষক এবং চাষী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
A disaster management volunteer carries a sick child as villagers on the Bay of Bengal coast are evacuated as a precaution against Cyclone Amphan Source: AP
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কতো দিন লাগবে?
মশারফ হোসেন বলেন,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দিন দশেক লাগবে। আরও স্বাভাবিক হতে মাস খানেক সময় লাগবে। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, এর সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে কর্মকর্তাদের নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।”
শঙ্কর লাল দাশ বলেন,
“আমন চাষের মাধ্যমে এই ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে। জরুরি ভিত্তিতে এমন কোনো ফসল উৎপন্ন করা যাবে না যা দিয়ে ফসলের এই ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে। সামনে আমনের মৌসুম আসছে। আমন হলো দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র প্রধান ফসল। এটা দিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে।”
এদিকে, আম্ফান-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় ত্রাণ, উদ্ধার ও চিকিৎসা-সহায়তা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশন।