আমেরিকার কবি ওয়ালেস স্টিভেন্স বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিষটি আর কিছু নয়, পৃথিবী নিজেই!
কিন্তু কোভিড-19 বৈশ্বিক মহামারীর ফলে আমাদের পৃথিবী সংকুচিত হয়ে পড়েছিল চার দেয়ালের মধ্যে, বড়জোর নিজের দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে।
গত বছর লক ডাউন তুলে নেওয়ার পর দেশের কর্তৃপক্ষ আন্তঃরাজ্য ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়। দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ানদের আর কোন বিকল্পও ছিল না। কেননা করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বন্ধ ছিল।
দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ ও পর্যটন উৎসাহিত করতে ট্যুরিজম অস্ট্রেলিয়া নয় মিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপন কর্মসূচি হাতে নেয়।
অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্স (ABS) এর তথ্যমতে গতবছরের জুন মাস নাগাদ দুই বছরে আন্তর্জাতিক বহির্গমন ৯৪ দশমিক ৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছিল।
সিডনীর ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির পর্যটন বিভাগের শিক্ষক ডক্টর ডেভিড বিয়ারম্যান বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারী যেন মানুষের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অতিমারীর সময়ে মানুষ নিজের গন্ডিতেই আটকে ছিলও বিধিনিষেধের বেড়াজালে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০২০-২০২১ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীর সংখ্যা ৯৭ দশমিক ৭ ভাগ হ্রাস পেয়েছিল। গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০৯৭০ জন।
ফলে আন্তর্জাতিক পর্যটন খাত থেকে জাতীয় আয় ৯৬ দশমিক ১ ভাগ কমে গিয়েছিল।
কোভিডের ফলে আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন শিল্প বা বিমান ভ্রমণেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। থমকে গেছে আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন। প্রমোদ ভ্রমণ ছাড়াও কোভিড-19 অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসীদের জীবনকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। অভিবাসী, প্রবাসী কর্মী, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, দর্শনার্থী, সবাইকেই তার ফলে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।অতিমারীর শুরু থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নাটকীয়ভাবে কমে যায়। অতিমারীর শেষে ২০২২ সাল নাগাদ তা আবার আগের অবস্থায় ফিরবে বলে সবাই আশা করেছিলেন কিন্তু পরিসংখ্যান দেখে ধারনা করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরেও বৈদেশিক অভিবাসন ঋণাত্মক থাকবে। ২০২৪-২৫ সালের দিকে তা ধীরে ধীরে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যা অতিমারীর পূর্বে প্রাক্কলিত হিসাব থেকে যা সংখ্যায় ৭ লক্ষ কম।
Tourists wearing facemasks as a preventive measure against the spread of coronavirus are seen at the Emerald Buddha Temple inside the Grand Palace in Bangkok. Source: AAP
অস্ট্রেলিয়ানিবাসী অভিবাসীদের জন্য স্বদেশে থাকা পরিবার ও আত্মীয়-পরিজনদের সাথে হৃদ্যতা রক্ষা খুব কঠিন ছিল।
এসবিএস এরাবিক এর টিভি সাংবাদিক নাবিল আল নাশার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আমার পরিবারের সদস্যরা সারা পৃথিবীর চারটা মহাদেশে ছড়িয়ে আছে তাই আমরা আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ছাড়া একত্র হতে পারিনা। আমি আশা করেছিলাম, আমার একমাত্র বোনের বিয়েতে আমি অংশ নিতে পারবো কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কঠিন বিধিনিষেধের ফলে তা পারিনি।
কোভিডের ফলে শিক্ষা আর ব্যবসার জন্য ভ্রমণের ক্ষেত্রেও অনেক কিছুর রদবদল ঘটেছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণে অনিশ্চয়তা নিয়োগকারীদের উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেননা তাদেরকে বিমা আর আর্থিক দায়বদ্ধতার কথা বিবেচনা করতে হয়।
আন্তর্জাতিক সম্মেলন, শিক্ষা এবং কাজের ক্ষেত্রে অতিমারীর কি কি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে — সে প্রসঙ্গে ডক্টর সিনারব্রিংক বলেন, মুখোমুখি বসে সভা করা বা কনফারেন্স ট্রাভেল আজকাল একটা বিলাসিতা হয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে—এটাই বাস্তবতা।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘকাল ধরে বসবাসকারী অনেক প্রবাসী নিজের শেকড়ে ফিরতে চান যাতে তারা নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আরও ভাল করে জানতে পারেন। তাদের অন্যতম একজন হচ্ছেন এসবিএস এর প্রতিবেদক বিওয়া কুওন। তিনি ম্যান্ডারিন ভাষা শিখতে ২০১০ সালে চীনে গিয়েছিলেন। মিস বিওয়ার জন্ম আর বেড়ে উঠা এদেশেই। নিজের আদি সংস্কৃতির স্বরূপ বুঝতে তার মত অনেকেই স্বদেশে কখনো না কখনো যেতে চান।
কোভিড পরবর্তীকালে স্বল্প খরচের পর্যটন খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে অনেকে মনে করেন। ডক্টর বিয়ারম্যান বলেন, স্বল্প খরচে অবকাশ যাপনের জন্য থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সহ দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ অস্ট্রেলিয়ার অনেকের পছন্দের শীর্ষে ছিল। উদাহরণস্বরূপ ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ মিলিয়ন। কিন্তু ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় এক মিলিয়ন এবং ২০২১ সালেও তার কোন পরিবর্তন হয়নি।
ডক্টর বিয়ারম্যান বলেন, উক্ত সব দেশের পর্যটন অবকাঠামো বর্তমানে নিশ্চয় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব দেশই পর্যটক টানতে চায়। কিন্তু এইসব দেশে কোভিড আক্রান্তের উচ্চহার বিদ্যমান। অতিমারীর কথা বিবেচনায় রেখে কোভিড টেস্ট এবং কোয়ারেন্টিনের আয়োজন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা দরকার কিন্তু এসব খরচ আবার ভ্রমণের খরচের সাথে যোগ হয়। সব মিলিয়ে ভ্রমণের খরচ আর স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পর্যটনশিল্পে।
স্বশরীরে ভ্রমণের বিকল্প হতে পারে ভারচ্যুয়াল ভ্রমণ। ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে দেওয়া এক বক্তৃতায় ডেভিড এটেনবরো গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ এর ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটি ট্রিপের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটি অন্য এক বাস্তবতায় দরশনার্থীকে নিয়ে যায় যা খুবই রোমাঞ্চকর।মানুষ কেন ভ্রমণ করতে যায় — এ বিষয়ে ম্যাককোয়েরি ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সিনারব্রিংক বলেন, আফ্রিকায় মানবজাতির আবির্ভাবের সময় থেকে তারা ভ্রমণ করছে। মানুষ চরিত্রগতভাবেই গতিময় আর ভ্রমণশীল। আমরা ভ্রমণ করি অভিবাসনের জন্য, তীর্থে যাওয়ার জন্য, আমাদের যাযাবরী প্রবণতা আর আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে।
Large Group of Diverse People with Different Occupations Source: Getty Images
আদি ও বর্তমানে মানুষের গমনাগমন দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম অধিত বিষয়। বর্তমানে যখন অতিমারীতে মানুষের গমনাগমন থমকে আছে, মানবসভ্যতার অন্তর্যাত্রা ও অভিযাত্রা কিন্তু থেমে নেই।
পৃথিবীকে দেখার অভিপ্রায়ের পাশাপাশি মানুষের ভ্রমণপিপাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে— এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা করে থাকেন দার্শনিকরা। ডক্টর সিনারব্রিংক এ বিষয়ে বলেন, মানুষ বিদেশ দেখতে ভ্রমণ করে, কিন্তু মানুষ নিজের কাছে ভ্রমণ করেনা, নিজের কাছে যায় না। হয়তো নিজ ভূমিতে থেকে নিজেকে দেখার এটাই একটা উৎকৃষ্ট সময় হতে পারে।
প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: